শুক্রবার, ২০ মে, ২০১৬

হেজাজুল আরব থেকে সৌদি আরব

হেজাজুল আরব থেকে সৌদি আরব



জাজিরাতুল আরবের প্রদেশ সমূহ


সৌদি আরবের ইতিহাস

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাসহেজাজুল আরব থেকে সৌদি আরব‘সৌদিআরব’ নামের উৎস ও ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল গঠনে সৌদি রাজবংশের ভূমিকা

বর্তমান এই যুগে আরব বলতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মুসলিম জাহানের ঐতিহাসিক স্থান ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কাতুল মুয়াজ্জামা,এটি পূর্বে বাক্কা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মহান আল্লাহ তা'লা তার ঐশীগ্রন্থ কুরআনে পাকে ঐ স্থানকে "উম্মুল কুরা" তথা "আদি নগর" হিসেবে অবহিত করেছেন, এই মক্কা নগরীকে কেন্দ্র করেই ইসলামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় এবং এর অন্তর্নিহিত ইতিহাস ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়।

১৮৮০ সালের পূর্বে আরব ইতিহাসের যে পরিচয় পাওয়া যায়,সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গেলে ইতিহাস বলে,সে সময়ের আরবীয়দের মধ্যে ছিল সত্যের উজ্জীবিত আদর্শ, নিয়মনীতি, সাম্য,মৈত্রীর এক আভিনব কানুন শৃংখলার বিশ্ময়কর পরিবেশ। আরবীয়দের আদর্শের জাগরণের সৌরভে সুশোভিত হয় সারা বিশ্ব। ততকালীন সময়ে তাদের জীবনাচার ও শিষ্টাচার এমনিভাবে প্রভাবিত করে ছিল যে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আরবীয়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে তাদের রীতি-নীতি অনুস্বরন করত। তারাই ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরিচালক ও সংস্কারক।কেননা,তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সংবিধান রচনা হয়েছিল বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী মানবতার পথ প্রদর্শক বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর আলোকিত সত্যের আদর্শ থেকে এবং তিনি কুরআন-সুন্নাহের আলোকে তাহার উম্মতগণকে ইসলামী গণতন্ত্র-এর যে শিক্ষা দিয়েছেন,তার বিস্তার লাভ করেছিল আরব ভূ-খন্ড থেকেই।

সেক্ষেত্রে তখনকার আরবীয়দের আদর্শ ছিল শিক্ষনীয় এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল দৃষ্টান্তমূলক। সে আমলে আরবে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মের অনুসারিগণ তাদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে এবং মুসলমানদের দিনে দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রভাব দেখে আরবে অবস্থানরত অন্যান্য কাফির, ইয়াহুদি,নাসারারা ভীষণভাবে ব্যাথিত ও আতংকিত হতে থাকে। তারা তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি হারানোর ভয়ে মুসলমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ছদ্মবেশে মুসলমানদের আদর্শ দুর্বল ও ধ্বংস করার নিমিত্তে সর্বদা চেষ্টা চালাতে থাকে। শত চেষ্টার পরেও তারা খুব কমই সফল হয়। কারণ,মুসলমানদের অন্তরে ছিল আল্লাহ ও তার হাবিবের একনিষ্ঠ ভালবাসা এবং কুরআন-সুন্নাহের আদর্শে গড়া প্রবিত্র ঈমান। তারা তখন আরবের মুখোশদারী কিছু মুসলমান তথা মুনাফিকদের সহযোগীতায় তাদের প্রক্রিয়াকে বেগবান করে। যেমন মুসলমানগণ যখন ইবাদতে মাশগুল থাকতেন,তখন তারা মুসলমানদের ন্যায় রূপধারণ করে মুসলমানদের ইবাদাত ও ধর্ম-কর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'লা তাঁহার প্রবিত্র কুরআনুল কারীমে "সূরা মায়েদা"এর ৫৭ নং আয়াত থেকে ৬০ আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যক্রম সম্পর্কে ঈমানদারগণকে সাবধান করেছেন।



ওসমানীয় সম্রাজ্য (১৯১৪ সাল)


কিন্তু আল্লাহ ও রাসুলের দুশমনের দল তথা ইয়াহুদি, নাসারা, কাফের,মুনাফিকরা অন্যান্য সকল ইবাদত বন্দেগিতে ক্ষতিসাধন করলেও কিন্তু তাদের দ্বারা নবী কারীম (দ.)-এর গুণগাণ,দরুদ ও সালাম পড়া তাদের নিকট আসম্ভব হয়ে পড়ত। ফলে তাদের কার্যক্রম ব্যহত হতো। পরে তারা সম্মিলিতভাবে চিন্তা করতে লাগল যে,মুসলমাদের অন্তর থেকে কিভাবে নবীর প্রেম তথা দরুদ সালাম বের করা যায়। তারা উপলব্ধি করতে পারল যে,নবীর প্রতি ভালবাসাই হচ্ছে মুসলমানের ঈমান ও আদর্শ মজবুত থাকার প্রধান ভিত্তি। আর তা ধ্বংস করতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। ফলে মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হলে তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দিলে অন্য ধরমের অনুসারীরা মুসলমানদেরকে ঘৃনা অবজ্ঞা করতে থাকবে। আর তা যদি বাস্তবায়ন করতে হয়,তাহলে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তখনই তাদের দৃষ্টি পড়ল মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর শক্তিশালী দেশ তুরস্কের দিকে। ১৮৮০ সালের দিকে তুরস্কবাসী ছিল অন্যান্য মুসলিম দেশের চেয়ে অধিক নবী প্রেমে উজ্জীবিত। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে মিলাদুন্নাবী (দ.) এবং কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্য ও মূলমন্ত্রকে প্রচার প্রসার করতেন। তুরস্কবাসীর এই ধরণের অনুষ্ঠান তাদের সহ্য হত না। ফলে তারা তুরস্ক প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে। তখন তৎকালীন তুরস্কের শাসক গোষ্ঠীর নাম ছিল সুলতানাতুল ওসমানিয়া এবং বাদশা ছিলেন মুস্তফা কামাল পাশা এবং রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। তখন প্রশাসনের নেত্রীত্বে অধিকাংশ আরব ভূমিকে শাসন করা হত। তার মধ্যে তুরস্কের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অন্যতম প্রদেশ হলো 'নজদ',যা এখন সৌদ আরবের রাজধানী রিয়াদ নামে খ্যাত।



মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদী


তৎকালীন আমলে নজদের গভর্নর ছিলেন রশিদ। আর গভর্নর রশিদ কর্তৃক গঠিত গোত্র শাখার নাম ছিল রশিদীয়া গোত্র এবং রশিদীয়া গোত্রের মাধ্যমে নজদের সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। তখন রশিদীয়া গোত্রের আদর্শ ছিল সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক। কিন্তু নজদের কিছু সংখ্যক লোক এবং তাদের শীর্ষ নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ ছিল খারেজী মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের ইতিহাসে কথিত আছে যে,৬৬১ খ্রি: বিদ্রোহী খারেজীগণ হযরত আলী (রা:)কে ইসলামের শান্তি-শৃংখলা কারণ বলে দায়ী করে। পরে খারেজী গোত্রের একজন সদস্য যার নাম ছিল আব্দুর রহমান ইবনে মূলজিম হযরত আলী (রা:)কে নামায থেকে ফেরার পথে বিষাক্ত ছুরির অব্যর্থ আঘাতে ৬৬১ খ্রি: ২৭ জানুয়ারি ২১ রমজান হযরত আলী (রা:) কে শহীদ করে দেয়। সেই খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও প্রচার প্রসারের লক্ষে সৌদ এবং তার পুত্র আব্দুল আজিজ একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকে এবং তাদের গঠিত গোত্র পতিদের নিয়ে ধীরে ধীরে সুন্নি মতাদর্শের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মতানৈক্য করতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ওহাবীদের গোঁমর ফাঁস নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, প্রখ্যাত ভন্ড নবী মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের একজন বংশধর, সে নজদ প্রদেশের আল উয়ানীয়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যার নাম ছিল "মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদী, সে ছিল সৌদের শ্বশুর। সে বাল্যকাল থাকে ধর্ম বিরোধী ছিল এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সর্বদা জামাতা সৌদকে সহযোগীতা করত। শেষ পর্যন্ত সৌদের গোত্র খারেজী আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। একথা অবশ্যই নবী কারীম (দ:) এর হাদীসে বর্ণিত আছে যে, মসজিদে নববীতে নবী কারীম (দ:) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ কালে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের নাম ধরে এবং সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য দোয়া করা অবস্থায় একজন নজদের অধিবাসী সাহাবী,তাঁর নাম ছিল আবুল মুকাররাম, তিনি নবী কারীম (দ:) এর প্রতি আরজ করলেন,ইয়া রাসূলুল্লাহ (দ:)! আমি নজদ থেকে এসেছি, আমার মাতা-পিতা ও আমার নজদ প্রদেশের জন্য একটু দোয়া করুন। এভাবে ক্রমান্বয়ে তিন তিনবার বলা সত্বেও নবী কারীম (দ:) তার নজদ প্রদেশের জন্য দোয়া করেননি। নবী কারীম (দ:) আবুল মুকাররাম (রা:)কে ডেকে বল্লেন- হে আবুল মুকাররাম! আমি এই কারণে নজদের জন্য দোয়া করিনি যে,কেননা ঐ নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে(আমার কুরআন সুন্নাহ ও সালাতুস সালামের বিপক্ষে প্রচার আরম্ভ হবে এবং ঐ নজদী শাসকগোষ্ঠী আমার আহলে বাইতকে ভালবাসে না)। সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহকে তারা নির্যাতিত করবে। আবুল মুকাররাম নবী কারীম (দ.) এর এইরূপ বর্ননা শ্রবণ করার পর কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং পরে নবী কারীম (দ.) তাহার পিতা-মাতার জন্য দোয়া করলেন । রাসূলুল্লাহ (দ:) এক বাক্যে বুঝিয়েছেন যে,ঐ নজদ থেকে ইসলামের ক্ষতি সাধনকারী শত্রু নির্গত হবে। নবী কারীম (দ:) এর দেড় হাজার বছর আগের বাণী,যা আজ প্রমাণিত। নবী কারীম (দ:) এবং তাঁর খলিফাগণ যেভাবে ইসলামি গণতন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম সম্রাজ্যকে বৃদ্ধি করেছিলেন, তা বর্তমান আরবে বিলুপ্ত। কেননা, বর্তমান আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। যা নবী কারীম(দ:) এর আদর্শের বিপরীত। ফলে আজ সমস্ত মুসলিম বিশ্ব অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।



আরামকু কোম্পানি লোগো


অতঃপর আল্লাহর রাসূলের দেওয়া সুন্নি মতাদর্শ বিরোধীদের নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ এবং তার গোত্রের সকল কর্মীদেরকে নজদের গভর্নর রশিদ নজদ প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা কুয়েত চলে যায় এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। কুয়েতে অবস্থানরত অবস্থায় সেখানে এক মার্কিন কোম্পানি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। কোম্পানিটির নাম ছিল "আরামকু কোম্পানি "। তারা তাদের সাথে সহযোগীতার আলোচনা করে।ঐ আলোচনায় আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে বলেছিল যে,'তোমরা একটি কমিটি গঠন কর। আমরা তোমাদের প্রতি মাসে পাঁচ হাজার পাউন্ড স্বর্ণ দিয়ে সাহায্য করব। এবং তোমাদেরকে আমরা উন্নত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এমনভাবে গড়ে তুলব,যাতে তোমরা তোমাদের দেশে ফিরে যেতে পার। তোমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে দেব।' তারা মার্কিন আরামকু কোম্পানির সহযোগীতার প্রস্তাবিত কথাবার্তা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হল।অতএব সৌদ গোত্র আরামকু কোম্পানির সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৮৮০ সালে কমিটি গঠন করল। কমিটির নাম ছিল "ইখওয়ানুল মুসলিমিন" অর্থাৎ মুসলমানগন ভাই ভাই। অত:পর আরামকু কোম্পানি তাদের পাঁচ হাজার পাউন্ড সাহায্য দেয়া আরম্ভ করল এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের কৌশলের মধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণও দেয়। অথচ ইতিপূর্বে সৌদ গোত্র পেশায় ছিল জেলে। আর এমনিভাবে মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের দূরবলতার সুযোগে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র তুরুস্কে মুসলমানে-মুসলমানে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। অপরদিকে ঠিক এভাবেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইহুদী নাছারার একটি ব্রিটিশ চক্র ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের বেশ নিয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তারা ভারতে প্রবেশ করার পর ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সম্রাজ্যের মহান সম্রাট নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্কের কথা বলে এবং তারা তাঁহার সাথে একটি সন্ধি চুক্তি করে। সে সন্ধির নাম ছিল "আলিগড়ের সন্ধি"। এই সন্ধির নাম দিয়ে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের মুসলিম নওয়াব শাসকদের থেকে মীর জাফরের সহায়তায় ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষে মুসলিম নওয়াবদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলে ভারত উপমহাদেশে চিরতরে মুসলিম সম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তদ্রূপ মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের সৈন্যদেরকে সংগে নিয়ে নবী করীম(দ.) এর জীবনাদর্শ ও শানে-রেসালাত ক্ষুন্ন করতে থাকে।

এমনিভাবে সৌদ গোত্রের সৈন্যরা বিশ বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ার পর ১৯০১ সালে তারা নজদে হামলা করে। তখন তারা সর্বপ্রথম নজদের গভর্নর রশিদকে সুবহে সাদিকের সময় নামায পড়া অবস্থায় ধরে ফেলে এবং তারা রশিদের বুকের উপর বসে তার ঘাড় কেটে শরীর থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে তারা সেখানে আশিকে রাসূলদের অবস্থানস্থল চিহ্নিত করে এবং তার মধ্য হতে জ্ঞানীগুণী ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপর হঠাৎ অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এমনকি তারা সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী আশেকে রাসূল ও আওলাদে রাসূলগণের ৩/৪ দিনের নিষ্পাপ ছোট ছোট শিশুদেরকে পর্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘরে যা পেত সব লুটপাট করে নিত । ঘরে কারপেট থাকলে তা বের করে টুকরো টুকরো করে ফেলত ও তাদের মাঝে তা ভাগাভাগি করে নিত।এবং যেখানে মাটির স্থান দেখা যেত, সেখানে পানি দ্বারা ভিজিয়ে ফেলত। পানি দিয়ে ভিজিয়ে ফেলার কারণ ছিল মাটির নীচে নজদবাসীগণ তাদের মুল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, যেমন:স্বরণ,রৌপ্য চুরি-ডাকাতির ভয়ে নিরাপদ হিসেবে মাটির নীচে পুতে রাখত। আর যেখানে মূল্যবান সামগ্রী থাকত, সেখানে পানি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত ।

এভাবেই সৌদ সৈন্যরা মার্কিন "আরামকু কোম্পানির" পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে নজদের নিরীহ সুন্নি মুসলমানদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার নিপীড়ন করে। নবী করীম (দ:) এর বাণী:- তিনি ইরশাদ করেন-'সকল মুসলমান পরস্পর ঈমানী ভাই। সে হিসেবে প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানদের রক্ত,ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম। 'তিনি আরো ইরশাদ করেন:-

একজন মুসলমান যদি অন্য মুসলমানের হাত ও মুখ দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ না থাকে, তবে সে প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান নয়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।

মানবজাতির মহান সংবিধান মহাগ্রন্থ প্রবিত্র কুরআনে পাকের ২৫তম পারার সূরা আশশূ'রা এর ২২-২৩নং আয়াতে কারীমাগুলোতে আল্লাহ তা'লা ইরশাদ করেন

হে রাসূল(দ:)! আপনি বলে দিন, তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের ভালবাসা ছাড়া কোনো প্রতিদান চাই না।

হে আমার মুসলমান ভাইগণ! আপনাদের কাছে কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রশ্ন রাখলাম, তারা কোন ধরণের মুসলমান ?

অতঃপর সৌদ গোত্রের সৈন্যরা পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে মক্কা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা এবং মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীতে হামলা করা যায়। তৎকালীন আমলে মক্কা শরীফের গভর্নর ছিলেন হুসাইন শরীফ। তাঁর শাসনামলে তারা মক্কা শরীফে আক্রমণ করে ও সাথে সাথে মক্কা শরীফের গভর্নর হুসাইন শরীফকে আটক করে। অবশেষে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম উম্মাহের ঐতিহাসিক স্থান মক্কা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুলj মুয়াল্লা এবং জান্নাতুল বাকী শরীফের পবিত্র মাটিতে দাফনকৃত প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম ও আনসার, মুহাজির এবং আশেকে রাসূলগণের কবর ও রাওযা শরীফকে বিভিন্ন ধারালো ট্রাক্টর তথা মাটি কাটার গাড়ি বিশেষ দ্বারা উল্টিয়ে দেয় এবং তাতে কোনো প্রকার চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি । এমনকি তারা ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.) এর রাওযা শরীফ ভেঙে ফেলে । পরে রাসূল (দ.) এর রাওযা শরীফের দিকে অগ্রসর হয়। ওহাবীদের গোঁমর ফাঁক নামক গ্রন্থে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আআব্দুল ওহাব নজদী এবং অন্যদিকে সে আবার সৌদের শ্বশুরও হয় । অতএব সৌদের শ্বশুর আব্দুল ওহাব নজদীর নেতৃত্বে এই হামলা পরিচালনা করা হয় এবং সে এমন ব্যক্তি,যে সর্বপ্রথম রাসুলে কারীম (দ.)এর রাওযা শরীফের দিকে গেল । তখন আল্লাহ তা'লার হুকুমে আকস্মিকভাবে দুটি সাপ এসে তাদেরকে নবীজীর রাওযার দিকে পৌছার পথে তৎক্ষণাৎ বাধাগ্রস্ত করল । ফলে তারা ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হলো এবং পরে তা আর সম্ভবপর হয়নি । তাই আজ পর্যন্ত নবী কারীম (দ.)এর রাওযা ব্যতীত অন্য কোন সাহাবীর রাওযা শরীফের চিহ্ন বা নিশান দেখা যায় না। এই কারণে বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও হাজীগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না যে, এখানে পূর্বে পৃথক পৃথক মাজার শরীফ অবস্থিত ছিল। মক্কা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীর পূর্বের অবস্থার চিত্র এবং সেখানে সাহাবায়ে কেরামের রাওযা শরীফের পূর্বের দৃশ্য ও নবী করীম (দ.)এর বিভিন্ন মু'জিযার দর্শনীয় স্থানসমূহের বর্তমান ধ্বংসাবশেষ চিত্র নিয়ে লিখিত "আল মুকাদ্দেস" নামক গ্রন্থে চিত্রসহ স্ববিস্তারে মক্কা ও মদীনা শরীফের পূর্বের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থখানা আপনাকে দলিল স্বরূপ সহায়তা করবে । অতঃপর এভাবেই সৌদের গোত্র মার্কিন "আরামকু কোম্পানি"-র সহযোগীতায় আরবের বুকে সুন্নি মতাদর্শকে ধ্বংস করতে সমর্থ হলো এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল।

পরবর্তীতে সে সময়ের মদীনাবাসীরা তাদের কঠোর নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মদিনা ছেড়ে পাহাড়ে-পর্বতে চলে যায় এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন । তার প্রমাণ হলো মদীনার অদূরে পাহাড়-পর্বতে অবস্থানরত বর্তমান অধিবাসী । এমনকি আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূল (দ.) বণিকগণ আপন জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে নিজ বাসস্থান ছেড়ে জানমাল রক্ষার্থে বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছিলেন । যারা যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে সুন্নি মতাদর্শ ও সালাতুস সালাম এবং তৌহিদ এবং রিসালাত প্রতিষ্ঠা করেন। তাই আজ পর্যন্ত সেই সালাতুস সালামের ঝান্ডা সারা বিশ্বে উড়ছে । খারেজীরা এখনও কাফের মুনাফিকদের সহযোগীতায় বিভিন্ন দেশে ও জেলায় এবং গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে নবী প্রেমিকগণ জেগে উঠতে না পারে। কেননা তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীর প্রেম যাতে মুসলমানদের অন্তর থেকে চিরতরে মুছে যায়। আর নবীর প্রেম ও আদর্শ ধ্বংস করতে পারলেই মুসলমানদের ঈমান, আমলও নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে মুসলমান মুসলমানে লড়াই চলতে থাকবে। এটাই হলো খারেজী -ওয়াহাবীদের মূল প্রচেষ্টা। অতএব পরবর্তী পর্যায়ে যখন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে নির্যাতিত আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূলগণ হেজাজুল আরব থেকে চলে যান। তখন সৌদের গোত্র ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক থেকে নজদ ও মক্কা -মদীনা শরীফ দখল করে শাসনভার তাদের অধীনে নিয়ে আসে এবং সাথে সাথে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর হেজাজুল আরবের নাম পাল্টিয়ে দেয় এবং নিজ নামানুসারে "সৌদ আরব " রাখে,নজদ প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে "রিয়াদ" নামকরণ করে। উল্লেখ্য যে,এখানে তুরস্কের বাদশাহ মুস্তফা কামাল পাশার কিছুই করার ছিল না। কারণ, মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে সবদিক থেকে এমনিভাবে গড়ে তুলে ছিল যে,তাদের দমন করা তুরস্কের বাদশার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে ।

পরিশেষে এইভাবেই তারা আরবের মূল ভূ-খন্ডে খারেজী এবং ওয়াহাবী মতবাদ ও তাদের ধ্বংসাত্মক শাসন ক্ষমতা যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত রাখে।

তথ্যসূত্র

ঊর্দূ এলবাম "তাশকিলে জাদীদ" (ভাষ্যকার রাশেদ আশরাফ, তার পিতার নাম আবদুল্লাহ।)দেওবন্দি মাযহাব:-সৈয়দ পীর গোলাম মুহাম্মদ মেহের আলী (র.)তারিখ ও নাজদে হেজাজ:- হযরত মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম কাদেরীখুনকা আঁসুও:-আল্লামা হযরত মুহাম্মদ মুশতাক নেজামী (র.)ওহাবী মাযহাব কা হাকীকাত:-হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হামিদ জিয়াউল্লাহ আল কাদেরীআল মুকাদ্দেস (মক্কা ও মদীনা শরীফের বিভিন্ন স্থানের অতীত ও বর্তমান চিত্র সংবলিত):-শাহ মুহাম্মদ আব্দুল হালিম আল মাদানীওহাবীদের গোঁমর ফাক:-হযরত মুহাম্মদ রতন মিয়া চিশতী (র.)হক্ব বাতিলের পরিচয় :-মাওলানা মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন আল কাদেরীওহাবী মাযহাবের নেপত্য কাহিনী :-(মূল) এইম.এম.গুমুজ।(অনুবাদ)হাফেয মাওলানা রুহুল আমিনইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফিরকা:-লেখক মাওলানা কাযী মুহাম্মদ মুঈনউদ্দিন আশরাফী

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস

সৌদি আরব হলো কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর একমাত্র মুসলিম দেশ। অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।



আবদুল্লাহ বিন সৌদ

সৌদি আরবের ইতিহাস

সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাসহেজাজুল আরব থেকে সৌদি আরব‘সৌদিআরব’ নামের উৎস ও ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল গঠনে সৌদি রাজবংশের ভূমিকা

রিয়াদের নিকটস্থ দিরিয়া নামের একটি কৃষিবসতির প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ বিন সৌদ। এই উচ্চাভিলাষী মরুযোদ্ধা ১৭৪৪ সালে আরবের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব [ওয়াহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা]-এর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে “দিরিয়া আমিরাত” গঠন করেন। তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে শিরক-বিদাত পালনের অভিযোগে এই দুজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। ওই “দিরিয়া আমিরাত”-ই বিশ্বের প্রথম সৌদি রাজ্য/আমিরাত। মুহাম্মদ বিন সৌদ তার পুত্র আবদুল আজিজের সাথে মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের মেয়ের বিয়ে দেন। এভাবেই সৌদ পরিবার ও ওয়াহাবী মতবাদের মিলনযাত্রা শুরু হয়। ১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ বিন সৌদ-এর মৃত্যু হলে তার ছেলে আবদুল আজিজ দিরিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়।

এই আবদুল আজিজ তত্কালীন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল ব্রিটেনের সাথে হাত মিলিয়ে তুরস্কের খলিফাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে থাকে। শ্বশুর ইবনে ওয়াহাবের ধর্মীয় মতবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তথাকথিত শিরক-বিদাত উচ্ছেদের নামে ব্রিটিশদের সাথে তুর্কি খিলাফত ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হয় আবদুল আজিজ। ১৭৯২ সালে মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের মৃত্যু হয়। ১৮০১/২ সালে আবদুল আজিজ তুর্কি খিলাফতের কাছ থেকে ইরাক দখল করে হজরত আলী (রা.) ও হজরত হুসেন (রা.)-এর মাজার শরিফ ভেঙে ফেলে। এর প্রেক্ষিতে ১৮০৩ সালে একজন শিয়া মুসলিম আজিজকে দিরিয়ায় আসরের নামাজরত অবস্থায় হত্যা করে।

এর পর আবদুল আজিজের ছেলে সৌদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতায় এসে তুর্কিদের পরাজিত করে ১৮০৩ সালে মক্কা ও ১৮০৪ সালে মদিনা দখল করে নেয়। দুই পবিত্র নগরী দখল করে তারা ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। তারা মক্কা-মদিনার বহু মুসলিমকে হত্যা করে। সবই করা হয় সেই শিরক-বিদাত উচ্ছেদের নামে! ওয়াহাবী মতবাদের ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযানের অজুহাতে তারা বহু সাহাবীর কবরস্থান ধ্বংস করে। এমনকি খোদ মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কবরে ছায়াদানকারী মিম্বরগুলোও এরা ভেঙে ফেলে! এসবই চলে ব্রিটিশদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা নিয়ে।



খলিফা ২য় মাহমুদ

ইরাক-মক্কা-মদিনায় সৌদিদের এই ধ্বংসযজ্ঞে তত্কালীন তুর্কি খলিফাগণ ভীষণ রুষ্ট হন। ১৮০৮ সালে খলিফা ২য় মাহমুদ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদিদের দমনে শক্তিশালী সেনাদল পাঠান। ষড়যন্ত্রকারী ব্রিটিশরা এবার আর সৌদিদের বাঁচাতে পারেনি। ১৮১৮ সালে সৌদের ছেলে, তত্কালীন সৌদি শাসক আবদুল্লাহ বিন সৌদ তুর্কিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

আবদুল্লাহ বিন সৌদকে বন্দী করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই পবিত্র নগরী ও বহু মসজিদ ধ্বংসের শাস্তি হিসেবে খলিফা ২য় মাহমুদ-এর নির্দেশে আবদুল্লাহ বিন সৌদ ও তার দুই ছেলেকে ইস্তাম্বুলে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা হয়।

এভাবেই প্রথম সৌদি আমিরাত (১৭৪৪-১৮১৮)-এর পতন হয় ও পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ আরবে উসমানিয়া খিলাফতের শাসনকর্তৃত্ব ফিরে আসে।

সৌদ পরিবারের দিরিয়ার আখড়া ১৮১৮ সালে ধ্বংস হয়ে গেলে প্রথম সৌদি আমিরাতের শেষ আমীর আবদুল্লাহর তুর্কি নামের এক পুত্র মরুভূমিতে পালিয়ে যায়। এই তুর্কি বিন আবদুল্লাহ পালিয়ে বনু তামিম গোত্রে আশ্রয় নেয়। পরে ১৮২১ সালে সে আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে এসে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

১৮২৪ সালে তুর্কি বিন আবদুল্লাহ উসমানিয়াদের নিয়োজিত মিশরীয়দের হটিয়ে দিরিয়া ও রিয়াদ দখল করে নেয়। রিয়াদকে রাজধানী করে গঠিত এই “নজদ আমিরাত” ইতিহাসে দ্বিতীয় সৌদি রাজ্য নামে পরিচিত। দ্বিতীয় সৌদি রাজ্যটি অবশ্য খুব কম এলাকাই দখলে নিতে পেরেছিল। এটি বেশিদিন টিকেওনি। এই নজদ আমিরাতের প্রধানকে “ইমাম” বলা হত এবং ওয়াহাবী মতাবলম্বীরাই ধর্মীয় বিষয়ে কর্তৃত্বশীল ছিল।

তবে এবার সৌদ পরিবারে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কথিত ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহকে তাঁর এক জ্ঞাতি ভাই মুশারি বিন আবদুর রহমান বিদ্রোহ করে ১৮৩৪ সালে হত্যা করে। তবে ক্ষমতা পায়নি মুশারি। তুর্কির ছেলে ফয়সাল এরপর নজদ আমিরাতের ইমাম হয়।



আবদুর রহমান বিন ফয়সাল


সৌদ পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। অবশেষে ১৮৯১ সালে মুলায়দার যুদ্ধে উসমানিয়াদের অনুগত রাশিদী বাহিনীর হাতে দ্বিতীয় সৌদি আমিরাতের পতন ঘটে। সৌদিদের শেষ ইমাম আবদুর রহমান বিন ফয়সাল তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ পালিয়ে যায়।

বিশাল বালুকাময় রুব আল খালি মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আবদুর রহমান তার পুত্র আবদুল আজিজকে নিয়ে দক্ষিণপূর্বে মুররা বেদুইন গোত্রে গিয়ে পালায়। সেখান থেকে তারা বাহরাইনের রাজপরিবারের কাছে গিয়ে কিছুদিন আশ্রয় নেয়। তার পর ১৮৯৩ সালে আবদুর রহমান ও তার পুত্র শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ দালাল কুয়েতি আল-সাবাহ রাজপরিবারের আশ্রয় পায়।

কুয়েতি রাজপরিবারের সহায়তায় সৌদিরা উসমানিয়া খিলাফতের কর্তৃত্বাধীন নজদে একের পর এক চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকে। ওয়াহাবী মতবাদের আলোকে পরিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে এসব হামলা চলতে থাকে। কিন্তু এসব হামলায় সৌদিরা তেমন কোনো বড় সাফল্য পায়নি। ১৯০১ সালে সারিফের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আবদুর রহমান তার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের সব উদ্যম হারায়।

১৮৯৯ সালের জানুয়ারিতে কুয়েতের আমির মুবারক আল সাবাহ ব্রিটেনের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কুয়েতকে ব্রিটেনের করদরাজ্য (Protectorate)-এ পরিণত করেন। তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের প্রভাবের বিরুদ্ধেই কুয়েত এই চুক্তি করে ব্রিটেনের সাথে।



আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ – বর্তমান সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা


সৌদ পরিবারের লড়াইটিও ছিল উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধেই। তাই ১৯০১ সালে সারিফের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে পিতা আবদুর রহমান হতোদ্যম হলেও পুত্র আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ আবারও আশার আলো দেখে। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ১৯০১ সালের শেষের দিকে কুয়েতের আমির মুবারকের কাছে উসমানিয়াদের নিয়ন্ত্রিত রিয়াদ আক্রমণের জন্য সাহায্য চায়। ব্রিটিশ মদদপুষ্ট কুয়েত সানন্দে ইবনে সৌদকে ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করে।

১৯০২ সালের ১৩ জানুয়ারি ইবনে সৌদ সৈন্যসহ রিয়াদের মাসমাক দুর্গ আক্রমণ করে। মাসমাকের উসমানিয়া অনুগত রাশিদী প্রশাসক ইবনে আজলানকে হত্যা করে সৌদিরা। ইবনে সৌদ যুদ্ধজয় শেষে ইবনে আজলানের ছিন্নমস্তকটি নিয়ে দুর্গশীর্ষে আসে এবং নিচে সমবেত উদ্বিগ্ন রিয়াদবাসীর দিকে ছুঁড়ে মারে ।[1]

আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের রিয়াদ আমিরাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসে তৃতীয় সৌদি রাজ্যের সূচনা হয়।

এর পর সৌদিরা একে একে রাশিদীদের নজদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হটিয়ে দিতে থাকে। ১৯০৭ সালের মধ্যে সৌদিরা নজদের বিরাট এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।



William Henry Irvine Shakespear


১৯০৯ সালে ব্রিটিশরা সামরিক অফিসার William Henry Irvine Shakespear-কে কুয়েতে নিয়োগ দিলে সৌদ পরিবার আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। শেক্সপিয়ারকে ইবনে সৌদ সামরিক উপদেষ্টা বানিয়ে নেয়।[2]

১৯১৩ সালে সৌদিরা উসমানিয়া সৈন্যদের কাছ থেকে পূর্ব আরবের গুরুত্বপূর্ণ মরুদ্যান হাসা শহর দখল করে নেয়। এর পর পার্শ্ববর্তী কাতিফ শহরও সৌদিরা দখলে নেয়।

পরের বছর ১৯১৪ সালে বিশ্বজুড়ে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার মিত্রশক্তি জার্মানি-উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রিয়াদে ব্রিটিশরা শেক্সপিয়ারের মাধ্যমে সৌদিদের সাথে উসমানিয়া অনুগত রাশিদীদের যুদ্ধ লাগায়।[3]

১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত এই যুদ্ধে রাশিদীরা জয়ী হয় ও শেক্সপিয়ারকে হত্যা করে। রাশিদীরা শেক্সপিয়ারের শিরশ্ছেদ করে ও তার হেলমেট উসমানিয়াদের কাছে হস্তান্তর করে। উসমানিয়ারা সৌদিদের সাথে ব্রিটিশদের সম্পর্কের প্রমাণস্বরূপ শেক্সপিয়ারের হেলমেট মদিনার প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে দেখায়।

শেক্সপিয়ারকে হারিয়ে বিপর্যস্ত ইবনে সৌদ ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশদের সাথে দারিন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ব্রিটিশদের পক্ষে ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য প্রধান মেজর জেনারেল স্যার পার্সি কক্স ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি মোতাবেক সৌদি রাজত্ব ব্রিটিশদের করদরাজ্য (Protectorate)-এ পরিণত হয়।[4]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জার্মান-উসমানিয়া খিলাফতের দুর্বল অবস্থা ও আল-সৌদ পরিবারের সাথে ব্রিটিশদের সখ্য দেখে চিন্তিত হয়ে ওঠেন মক্কার উসমানিয়া সমর্থিত শাসক হুসাইন বিন আলী।

১৯১৫ সালের ১৪ জুলাই থেকে হুসাইন মিশরের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরি ম্যাকম্যাহনের গোপনে পত্র যোগাযোগ শুরু করেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯১৬ পর্যন্ত এই পত্র আদান-প্রদান চলতে থাকে। উসমানিয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত বিশাল আরব ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা মতবিনিময় করে।[5]

ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মদদে মক্কার শাসক সেই হুসাইন বিন আলী উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ তৈরি করে। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্সের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বিশ্বাসঘাতক হুসাইন মিডল-ইস্টার্ন ফ্রন্টে উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুরু করলে বহু উসমানিয়া সৈন্য বন্দী হয় ও অবশেষে উসমানিয়ারা ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়।



ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্স – আরববিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা – হলিউডের বিখ্যাত “Lawrence of Arabia” (১৯৬২) মুভিটি একে নিয়েই নির্মিত


১৩০০ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য মুসলিম খিলাফতের হাতছাড়া হয়ে যায়।

পুরস্কার হিসেবে ব্রিটিশরা ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর হুসাইন বিন আলীর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল্লাহকে জর্ডানের রাজত্ব ও তৃতীয় ছেলে ফয়সালকে ইরাকের রাজত্ব দেয়। হুসাইনকে রাখা হয় হেজাজ (পবিত্র মক্কা-মদিনা ও তাবুক অঞ্চল)-এর শাসক হিসেবে।



হুসাইন বিন আলী

এভাবে ১ম বিশ্বযুদ্ধ আল-সৌদ পরিবারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে। কেননা ব্রিটিশদের লেজুরবৃত্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ হুসাইন পরিবার এগিয়ে যায় এবং যুদ্ধ শেষে হুসাইন ও তার দুই ছেলে মিলে তিন দেশের রাজত্ব পায়। তবে নজদ (রিয়াদ ও তদসংলগ্ন অঞ্চল)-এর শাসক সৌদিরাই থেকে যায়।

দারিন চুক্তির আওতায় আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটিশদের কাছ থেকে বহু অস্ত্র ও মাসে ৫,০০০ পাউন্ড ভাতা (দালালির পুরস্কার) পেতে থাকে।

[6]

যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের উদ্বৃত্ত বিপুল গোলাবারুদ দিয়ে দেয়। ওই ব্রিটিশ অস্ত্র ও গোলাবারুদের সম্ভার নিয়ে সৌদিরা ক্রমধ্বংসমান উসমানিয়া খিলাফতের অনুগত রাশিদীদের ওপর দক্ষিণ-পশ্চিম আরব অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে। ১৯২০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত লড়ে রাশিদীরা শেষ পর্যন্ত সৌদিদের হাতে পুরোপুরি পরাজিত হয়। ফলে আরবে আল-সৌদ পরিবার নিয়ন্ত্রিত ভূ-খণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ইরাকে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত Percy Cox-এর মধ্যস্থতায় ১৯২২ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত Uqair Protocol-এর আওতায় ওই বিশাল অঞ্চলে সৌদি রাজত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।[7]

এ-সময় পর্যন্ত আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ কখনোই ব্রিটিশ অনুগত হেজাজের শাসক হুসাইনের সাথে সংঘাতে জড়ায়নি।

১৯২৪ সালের ৩ মার্চ আরেক ব্রিটিশ দালাল মুস্তাফা কামাল পাশা তুরস্কে অফিসিয়ালি খিলাফত বিলুপ্ত করে। সারা বিশ্বের মুসলিমদের সাথে মক্কার হুসাইন বিন আলীও মহানবী (সা.) আমল থেকে ১৩০০ বছর পর্যন্ত চলমান মুসলিমদের রাষ্ট্র খিলাফতের পতনে ব্যথিত হন। পৃথিবী থেকে খিলাফত মুছে গেছে, এটা হুসাইনের চেতনায় আঘাত করে। ব্রিটিশদের ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও ৫ মার্চ হুসাইন নিজেকে মুসলিমদের খলিফা ঘোষণা করেন।

ব্যস, এ-সুযোগটিই কাজে লাগায় খিলাফতের দীর্ঘদিনের শত্রু আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ। ব্রিটিশরা স্বাভাবিকভাবেই হুসাইনের নিজেকে খলিফা ঘোষণা করা মেনে নেয়নি এবং হেজাজের শাসক হিসেবে হুসাইনের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।

আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ কালবিলম্ব না করে হেজাজ আক্রমণ করে এবং ১৯২৫ সালের শেষ নাগাদ পুরো হেজাজ দখলে নিয়ে নেয়। ১৯২৬ সালের ৮ জানুয়ারি আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ মক্কা-মদিনা-জেদ্দার গোত্রীয় নেতাদের সমর্থনে নিজেকে হেজাজের “সুলতান” ঘোষণা করে। ১৯২৭ সালের ২৭ জানুয়ারি ইবনে সৌদ আগের নজদ ও বর্তমান হেজাজ মিলিয়ে Kingdom of Nejd and Hejaz ঘোষণা করে। ৪ মাস পর সেই বছরের ২৭ মে জেদ্দা চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা Kingdom of Nejd and Hejaz-কে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।[8]

নতুন জেদ্দা চুক্তি, ১৯২৭-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ-সৌদের “Protectorate” স্ট্যাটাসের দারিন চুক্তি, ১৯১৫-এর সমাপ্তি ঘটে।

পরবর্তী ৫ বছর আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ তার দুই রাজত্বকে আলাদা রেখেই শাসন করে। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইবনে সৌদ তার দুই রাজত্বকে একত্রিত করে তার নিজের ও বংশের পদবি অনুসারে দেশের নাম “Kingdom of Saudi Arabia” (আরবি: المملكة العربية السعودية‎ al-Mamlakah al-‘Arabiyyah as-Su‘ūdiyyah) ঘোষণা করে।

এভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উসমানিয়া খিলাফতবিরোধী নীতির প্রকাশ্য সমর্থক হিসেবে, পদে পদে ব্রিটিশদের মদদ নিয়ে, দালাল আল-সৌদ পরিবার ১৯৩২ সাল থেকে Kingdom of Saudi Arabia নামে মুসলিমদের পবিত্র ভূমি দখলে রেখে শাসন করে যাচ্ছে।


১. মিশরের মুরসি সরকারের পতনের পর সৌদি সরকারের ভূমিকায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই দালাল রাজপরিবারের ইতিহাস তাই মুসলিম উম্মাহর জেনে রাখা প্রয়োজন।২. সৌদ পরিবার মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক উসমানিয়া খিলাফত ভাঙতে ওয়াহাবী মতবাদকে ব্যবহার করেছিল। আর সৌদ পরিবার জেনে-বুঝে দালালি করেছে তত্কালীন বিশ্বমোড়ল ও খিলাফতের শত্রু ব্রিটেনের।৩. মাজারকেন্দ্রিক শিরকের চর্চা আর কবর জিয়ারত এক কথা নয়। মাজারকেন্দ্রিক শিরক পরিত্যাজ্য, কিন্তু কবর জিয়ারত একটি প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ।৪. এই নোটে বহু বই থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে – তবে তথ্যগুলো এতই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, কম-বেশি সব তথ্যই Wikipedia-য় আছে। এমন কি, সৌদি দূতাবাসের ওয়েব সাইটেও আছে [অবশ্যই ব্রিটিশদের দালালির বিষয়টি বাদ দিয়ে][9]৫. যারা সৌদি আরবের ইতিহাস সামগ্রিকভাবে একটি বই থেকেই জানতে চান, তারা Cambridge University Press থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত Madawi al-Rasheed-এর লেখা A History of Saudi Arabia বইটি পড়তে পারেন।৬. প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ সিন্দি রচিত ২২ পৃষ্ঠার নিবন্ধ/বুকলেট “The Direct Instruments of Western Control over the Arabs: The Shining Example of the House of Saud” এ-বিষয়ে একটি অনবদ্য রচনা।

তথ্যসূত্র

Jump up↑https://en.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Riyadh_(1902)Jump up↑https://en.wikipedia.org/wiki/William_Henry_Irvine_ShakespearJump up↑https://en.wikipedia.org/wiki/Battle_of_JarrabJump up↑https://en.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_DarinJump up↑ https://en.wikipedia.org/wiki/Hussein-McMahon_CorrespondenceJump up↑ Abdullah Mohammad Sindi, “The Direct Instruments of Western Control over the Arabs: The Shining Example of the House of Saud”Jump up↑http://en.wikipedia.org/wiki/Uqair_Protocol_of_1922Jump up↑http://en.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Jeddah_(1927)#1927Jump up↑http://www.saudiembassy.net/about/country-information/history.aspx

বহিঃসংযোগ

সৌদিদের ভণ্ডামি:https://www.facebook.com/meghnawa/posts/218599681623127A History of Saudi Arabia(লেখক Madawi al-Rasheed) DOWNLOADপ্রফেসর ড. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ সিন্দি রচিত “The Direct Instruments of Western Control over the Arabs: The Shining Example of the House of Saud”:DOWNLOADaurnabarc.wordpress.com

বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬

সৌদিআরব’ নামের উৎস ও ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল গঠনে সৌদি রাজবংশের ভূমিকা

‘সৌদিআরব’ নামের উৎস ও ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল গঠনে সৌদি রাজবংশের ভূমিকা

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের অনুচর ও সেবাদাস আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটেনের অনুমতি নিয়ে হিজাজের নাম পরিবর্তন করে নিজ বংশের নাম অনুযায়ী এই বিশাল আরব ভূখণ্ডের নাম রাখে সৌদি আরব।

রক্তপাত, গণহত্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে ইবনে সৌদ দখল করেছিল হিজাজ। এই দেশই (বর্তমান সৌদি আরব) বিশ্বের একমাত্র দেশ যার নামকরণ করা হয়েছে দেশটির সংখ্যালঘু একটি গোত্রের নাম অনুসারে।

আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ছিল ‘নজদ’ নামক মরু অঞ্চলের অধিবাসী। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সে ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উগ্র মতবাদটির জন্ম দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রিটিশরা ওসমানি খেলাফত তথা অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ইবনে সৌদকে অনুচর হিসেবে বেছে নেয় এবং এ জন্য তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করে।
বাদশাহ্‌ আব্দুল আযীয ইবন সৌদ


তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হলে ইবনে সৌদের সাহস বেড়ে যায়। ফলে সে আরব অঞ্চলের নানা অংশে সেনা অভিযান চালাতে থাকে। ক্ষমতাসীন আলে-রশিদ গোত্রকে পরাজিত করার পর সৌদের বাহিনী ১৯২৫ সালে হিজাজে অভিযান চালায়। হিজাজের পবিত্র মক্কা ও মদীনা শহরসহ বন্দর শহর জেদ্দাহ, তায়েফ ও ইয়ানবু শহরে সৌদের বাহিনী অন্ততঃ বিশ-ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছিল।

মক্কা ও মদীনার পবিত্র মাজারগুলোর অবমাননা ও ধ্বংস সাধন ছিল সৌদের জঘন্য হঠকারিতার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য।

এরপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আরেক অনুচর হিজাজের শরিফ হুসাইনকে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার দুই পুত্র ফয়সল ও আবদুল্লাহকে যথাক্রমে ইরাক এবং নব-গঠিত জর্দান নামক দেশের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে রাজার উপাধি ব্যবহারের অনুমতি দেয় এবং তার দখল-করা অঞ্চলকে ‘সৌদি আরব’ হিসেবে ঘোষণা করারও অনুমতি দেয়। অবশ্য এইসব অনুমতি ব্রিটিশরা তখনই দেয় যখন ইবনে সৌদ এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার কোনো বিরোধিতা করবে না।



বাদশাহ আব্দুল আজিজ কর্তৃক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অনুমোদন পত্র

১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণা ব্যালফোর ঘোষণা নামে ইতিহাসে খ্যাত। এ ঘোষণা দেয়ার আগে ব্রিটিশরা সৌদি রাজা আবদুল আজিজের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র আদায় করেছিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল:

বাদশাহ আব্দুল আজিজ কর্তৃক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অনুমোদন পত্র


আমি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান--ফয়সলের বংশধর ও সৌদের বংশধর-- হাজার বার স্বীকার করছি ও জেনেশুনে বলছি যে, মহান ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার কুকাস-এর সামনে স্বীকারোক্তি করছি এই মর্মে যে, গরিব ইহুদিদেরকে বা অন্য কাউকে ব্রিটিশ সরকার যদি ‘ফিলিস্তিন’ দান করে দেন তাহলে এতে আমার কোনো ধরনের আপত্তি নেই। বস্তুত: আমি কিয়ামত পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের অভিমতের বাইরে যাব না।

— নাসিরুস সাইদ প্রণীত ‘আলে সৌদের ইতিহাস

একবার (১৯৪৫ সালে) বাদশাহ আবদুল আজিজ সৌদ ইহুদিবাদী ইসরাইল গঠনের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে বা ততক্ষণাত ব্রিটিশ সরকার ও ইহুদিবাদীদের পক্ষে দু’জন প্রতিনিধি এসে বাদশাহ আবদুল আজিজের সঙ্গে দেখা করে এবং বাদশাহকে তার সম্পাদিত সম্মতি-পত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন বাদশাহ তাদের বলেছিল:

আমি ইহুদিদের স্বার্থে কার্যত যা করে যাব তার ওপর বিশ্বাস রাখবেন। কি বলছি তার দিকে লক্ষ্য করবেন না। কারণ, এ ধরনের কথা না বললে আমি (ক্ষমতায়) টিকে থাকতে পারব না।

— নাসিরুস সাইদ লিখিত ‘আলে সৌদের ইতিহাস’, পৃ-৯৫৩

বাদশাহর এই কথা শুনে ব্রিটিশ সরকারের ও ইহুদিবাদীদের প্রতিনিধি খুশি হয়ে ফিরে যায়।

১৯১৪ সালে স্বাক্ষরিত আল-আকির চুক্তি অনুযায়ী ইবনে সৌদ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। আর বাহরাইন ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্বে থাকবে বলেও সৌদ কথা দেয় এবং উপসাগরীয় এলাকায় ব্রিটিশ নাগরিক ও ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলেও ওই চুক্তিতে অঙ্গীকার করে। বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকার ইবনে সৌদকে সমর্থন দেয়ার ও যে কোনো পক্ষ থেকে তার ওপর আক্রমণ করা হলে তা প্রতিহত করবে বলে ওয়াদা দেয়। [1]

এভাবে সে যুগে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ও শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচিত তুর্কি খেলাফতের ধ্বংস সাধনে সৌদি রাজা আবদুল আজিজ ও ব্রিটেনের যৌথ ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়িত হয়েছিল। সৌদের অনুগত ওয়াহাবি সেনারা তুর্কি মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছিল এবং রক্ষা করেছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের ও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে। তাই এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব নামক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ইসলাম রাজতন্ত্র সমর্থন করে না বলে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন।

উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটেন সৌদিদেরকে তথা সৌদি বংশের লোকদের ব্যবহার করে। ফলে তুর্কি সরকার ওয়াহাবিদের রাজধানী ‘দারইয়া’ শহরটি দখল করে নেয়। আর সৌদি সর্দার আমির আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করে প্রথমে কায়রোতে ও পরে তুরস্কে পাঠিয়ে দেন মিশরের শাসক মুহাম্মাদ আলী পাশা। তুর্কি খেলাফতের সরকার আমির আবদুল্লাহকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের অবস্থা দুর্বল হয়ে গেলে ব্রিটিশরা আবারও সৌদ গোত্রের লোকদের নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ব্রিটেন ইবনে সৌদের সঙ্গে কুখ্যাত ‘দারান’ চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৫ সালে। কুয়েতের শেখ জাবির আল সাবাহ ছিল সে সময় ব্রিটিশদের আরেক দালাল। ব্রিটিশরা এই দালালের মাধ্যমে ইবনে সৌদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার সৌদ-পরিবারকে প্রতি বছর ষাট হাজার পাউন্ড ভাতা দিতে থাকে। পরে এ ভাতা বাড়িয়ে এক লাখ পাউন্ড করা হয়। এ ছাড়া তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য সৌদ গোষ্ঠীকে তিন হাজার রাইফেল ও তিনটি মেশিনগান উপহার দেয় ব্রিটেন।[2]

ব্রিটিশ সরকার আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ক্ষমতা গ্রহণের উতসবে পাঠিয়েছিল স্যার কুকাসকে প্রতিনিধি হিসেবে। রাজা উপাধিতে বিভূষিত করে কুকাস তাকে বলেছিল,

হে আবদুল আজিজ, আপনি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

উত্তরে রাজা বলেছিল, আপনারাই আমার এ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন ও এ সম্মান দান করেছেন। যদি মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য না থাকত তাহলে এখানে আবদুল আজিজ আল-সৌদ নামে কেউ আছে বলেই জানত না। আমি তো আপনাদের (ব্রিটিশদের) মাধ্যমেই ‘আমির আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ’ শীর্ষক খেতাবটি অর্জন করতে পেরেছি। আমি আপনাদের এই মহানুভবতা আজীবন ভুলব না। আর আমার বিগত আচরণ ছিল আপনাদের সেবক ও ফরমানবরদার (গোলাম) হিসেবে আপনাদের ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করা।

ওই উৎসবে কুকাস ব্রিটিশ সরকারের দেয়া শাহী তামগা বা মেডেল রাজা আজিজের গলায় পরিয়ে দেয়। কুকাস বলে যায়: অচিরেই আমরা আপনাকে হিজাজ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর বাদশাহ বলেও ঘোষণা করব এবং তখন হিজাজকে ‘সৌদি সাম্রাজ্য’ বলে ঘোষণা করা হবে।

এ কথা শুনে রাজা আজিজ স্যার কুকাসের কপালে চুমু খায় ও বলে: "আল্লাহ যেন আমাদেরকে (সৌদিদেরকে) আপনাদের খেদমত (দাসত্ব) করার ও ব্রিটিশ সরকারের সেবা (গোলামি) করার তৌফিক দেন।

— মুহাম্মাদ আলী সাইদ লিখিত ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’, পৃ-২৬



শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১৬

পবিত্র শবে বরাত এর ফযীলত







শবে বরাতের ফযীলত


ইমাম গাযযালী (রহ:) তাঁর ‘এহইয়ায়ে উলূম আল-দ্বীন’ গ্রন্থে লিখেছেন,

মধ্য-শা’বান (মাস)-এর রাতে (অর্থাৎ, শবে বরাতে) ১০০ রাকআত (নফল) নামায পড়বে, যা’তে প্রতি রাকআতে সূরা ফাতেহার পর ১০ বার সূরা এখলাস থাকবে; তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফবৃন্দ) এটি তরক (ত্যাগ) করেন নি, যেমনিভাবে আমরা সম্পৃক্ত হয়েছি অতিরিক্ত নফল নামায ও আ’রাফাত রজনীর সাথে।

শায়খ ইসমাঈল হাক্কী তাঁর কৃত ’তাফসীরে রুহুল বয়ান’-এ বলেন,

তাফসীরকার উলামাদের কয়েকজন বলেন যে কুরআন মজীদে সুরা দুখান-এর ৩ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘লাইলাতুল মুবারক’ তথা ’বরকতময় রজনী’ বলতে মধ্য-শা’বানের রাতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে; আর এই রাতের ৪টি নাম: প্রথমটি ‘বরকতময় রজনী’, যেহেতু অসংখ্য মানুষ এই রাতে নেক আমল পালন করেন; আর বাস্তবিকই এতে আল্লাহতা’লার সৌন্দর্যের নেয়ামত আরশ-কুরসি থেকে দুনিয়াপৃষ্ঠ পর্যন্ত বিরাজমান প্রতিটি অণুকণার কাছে পৌঁছে থাকে, যেমনিভাবে তা ঘটে ’লাইলাতুল কদর’ রজনীতে, যা’তে ফেরেশতাকুল মহান আল্লাহতা’লার দরবারে হাজির হন।

সুরা দুখানের ৩-৪ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে,

নিশ্চয় আমি (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। তাতে (ওই রাতে) বণ্টন করে দেয়া হয় প্রতিটি হেকমতময় কাজ।

এই আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাথমিক জমানার তাফসীরবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:)-সহ বেশির ভাগ উলামা বলেছেন ওই রাত ‘শবে কদরের’; পক্ষান্তরে, হযরত একরিমাহ (রা:) ও তাঁর সাথে একমত পোষণকারী উলামাবৃন্দ বলেছেন যে সেটা ’শবে বরাত’।

উপরোক্ত আয়াতটি (৪৪:৩-৪) প্রসঙ্গে মাহমূদ আলুসী নিজ তাফসীরগ্রন্থে বলেন যে সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস (রা:), কাতাদাহ (রা:), ইবনে জুবাইর (রা:), মুজাহিদ (রা:), ইবনে যায়দ (রা:) ও আল-হাসান (রা:)-এর মতানুযায়ী উল্লেখিত রাত হলো শবে কদর। আর এটি-ই অধিকাংশ মোফাসসেরীন তথা তাফসীরকার উলেমার অভিমত। পক্ষান্তরে, হযরত একরিমাহ (রা:) ও তাঁর দল বলেন, “এটি মধ্য শা’বানের রাত” ।

আন্ নিসাপুরী তাঁর প্রণীত তাফসীরগ্রন্থে এই পবিত্র আয়াত প্রসঙ্গে বলেন,

বেশির ভাগ তাফসীরকার এই রাতকে লাইলাতুল কদর বলে চিহ্নিত করেছেন; কেননা, মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, ‘নিশ্চয় আমি তা (কুরআন) ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি’ (৯৭:০১)। আর অধিকাংশ উলামার মতে কদরের রাত রমযান মাসে।

আমরা আত্ তাবারীর বক্তব্যের অংশ বিশেষও এখানে উদ্ধৃত করবো; তিনি বলেন,

হযরত একরিমাহ (রা:)-এর মতো (প্রাথমিক যুগের) কতিপয় মুফাসসির দাবি করেন যে এই আয়াতে মধ্য শা’বানের রাতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

হযরত আনাস (রা:)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান

যে ৪টি রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন এবং নেয়ামত দেন। এগুলো হলো - শবে কদরের রাত ও এর পরে আগত সকাল; আ’রাফাতের রাত ও তৎপরবর্তী সকাল; শবে বরাত ও তৎপরবর্তী সকাল এবং প্রতি জুমু’আর রাত ও তৎপরবর্তী সকাল।

— দায়লামী শরীফ

হযরত আয়েশা (রা:)-কে রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন,

৪টি রাতে আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ ও দয়া বান্দাদের জন্যে অবারিত হয়:

১/ ঈদুল আযহার (আগের দিনগত) রাত;

২/ ঈদুল ফিতরের রাত;

৩/ মধ্য-শা’বানের রাত (শবে বরাত), যা’তে আল্লাহ বান্দার হায়াত নির্ধারণ করেন এবং রিযিকও বন্টন করেন; আর কারা কারা হজ্জ্ব করবেন, তাও নির্ধারিত হয়।

৪/ আ’রাফাত রজনী - আযান হওয়া অবধি।

আল-কুরআনে বর্ণিত “ওই রাতে বণ্টন করে দেয়া হয় প্রতিটি হেকমতময় কাজ” (৪৪:৪) আয়াতটি প্রসঙ্গে হযরত একরিমাহ (রা:) বলেন,

এটি মধ্য-শা’বানের রাত, যখন আল্লাহ পাক (আগামী) সারা বছরের বিষয়গুলো (নিয়মবদ্ধভাবে) সাজান। তিনি জীবিতদের কাউকে কাউকে মৃতদের তালিকাভুক্ত করেন, আর যারা আল্লাহর ঘরে হজ্জ্ব করতে যাবেন, তাদের নামও লিপিবদ্ধ করেন; এতে তিনি বেশি মানুষের নাম যেমন অন্তর্ভুক্ত করেন না, তেমনি তিনি কাউকে বাদও দেন না।

হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন হযরত রাসূলে করীম (দ:)-এর বাণী, যিনি এরশাদ ফরমান:

মানুষের হায়াত এক শা’বান থেকে আরেক শা’বান মাসে কর্তন করা হয়, যার দরুন কেউ হয়তো বিয়ে-শাদী করে সন্তানের জনকও হতে পারে, অথচ তার নাম জীবিতদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ভাগ্যে মৃত্যু লেখা হয়ে গিয়েছে।

হযরত আতা ইবনে এয়াসার (রা:) বলেন,

মহানবী (দ:) শা’বান মাসে যেভাবে (নফল) রোযা রাখতেন, অন্য কোনো মাসে সেভাবে রাখতেন না। আর এটি এ কারণে যে, ওই বছর যারা মৃত্যুবরণ করবেন, তা তাতে লিপিবদ্ধ হতো।

হযরত আয়েশা (রা:) বলেন,

রাসূলুল্লাহ (দ:) অন্য কোনো মাসে এতো অধিক (নফল) রোযা রাখতেন না যেমনটি রাখতেন শা’বান মাসে; কারণ এতে জীবিত যারা মারা যাবেন তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়, যে পর্যন্ত না কেউ বিয়ে করেন অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে; আর কেউ হজ্জ্ব করেন, কিন্তু তার নাম মৃতদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (ক:) থেকে বর্ণিত যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

মধ্য-শা’বানের রাত তোমরা এবাদত-বন্দেগী করে অতিবাহিত করো এবং ওই দিন রোযা রেখো। কেননা, নিশ্চয় সূর্যাস্ত থেকে আরম্ভ করে এই রাতে আল্লাহতা’লা সর্বনিম্ন (নিকটতম) আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কেউ কি আছো ক্ষমা চাইবার, যাকে আমি ক্ষমা করে দিতে পারি? কেউ কি আছো রিযক চাইবার, যাকে রিযক মঞ্জুর করতে পারি? কেউ কি আছো মসিবত/পরীক্ষায়, যাকে তা থেকে মুক্ত করে দিতে পারি?’ ইত্যাদি, ইত্যাদি, যতোক্ষণ না ফজরের সময় (সূর্যোদয়) হয়।

— হযরত আবদুর রাযযাক (রা:) ও ইবনে মাজাহ বর্ণিত

হযরত আয়েশা (রা:) বলেন,

এক রাতে আমি হুযূর পাক (দ:)-কে (ঘরে) না পেয়ে ’বাকী’ কবরস্থানে যাই (এবং সেখানে তাঁর দেখা পাই)। এই সময় তাঁর পবিত্র মস্তক মোবারক আসমানের দিকে ওঠানো ছিল। তিনি বলেন, ‘ওহে আয়েশা! তুমি কি আশংকা করো যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) তোমার প্রতি অন্যায্য আচরণ করবেন?’ আমি বল্লাম, এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমি মনে করেছিলাম আপনি হয়তো আপনার কোনো বিবি সাহেবার কাছে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মধ্য-শা’বানের রাতে মহান আল্লাহতা’লা সর্বনিম্ন (নিকটতম) আসমানে অবতরণ করেন এবং বনূ কালব্ গোত্রের মালিকানাধীন সমস্ত ভেড়ার গায়ে যতো লোম আছে, ওই সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন’।

— ইমাম আহমদ, ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী বর্ণিত হাদীস; শেষোক্ত হাদীসবিদ বলেন যে তিনি শুনেছেন ইমাম বোখারী (রহ:) একে ’দুর্বল’ শ্রেণীভুক্ত করেছেন, কেননা এর কতিপয় বর্ণনাকারী হাদীসটি একে অপরের কাছ থেকে সরাসরি বর্ণনা করেন নি।

উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে বিছানায় পাই নি; (খুঁজে পেয়ে) আমার হাত তাঁর কদম মোবারকের মধ্যভাগ স্পর্শ করে, আর ওই সময় তিনি মসজিদে ছিলেন। তাঁর পবিত্র দুই পায়ের পাতা খাড়া ছিল (অর্থাৎ, সেজদায় ছিলেন)। এমতাবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমি আপনার (আল্লাহর) শাস্তি হতে আপনারই ক্ষমার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি; আপনার না-রাজি হতে আপনারই রেযামন্দির আশ্রয় নিচ্ছি; আর আপনার (রুদ্ররোষ) হতে আপনারই মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আপনার যেভাবে প্রশংসা প্রাপ্য, সেভাবে আমি আপনার প্রশংসা করতে অপারগ। আপনি তা-ই, যেভাবে আপনি আপনার পরিচয় দিয়েছেন’।

— এই হাদীস বর্ণনা করেন ইমাম আহমদ, ইবনে মাজাহ, আবূ দাউদ, নাসাঈ ও তিরমিযী

অপর এক রওয়ায়াতে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

মধ্য-শা’বানের রাতে জিবরীল আমীন (আ:) আবির্ভূত হয়ে আমাকে বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনার সে’র (মস্তক) মোবারক আসমানের দিকে উত্থিত করুন।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এটি কোন্ রাত? তিনি জবাব দেন, ‘এটি সেই রাত যখন মহান আল্লাহতা’লা তাঁর রহমতের তিন’শটি দ্বার উম্মুক্ত করেন এবং সে সব ব্যক্তিকে মাফ করে দেন যারা তাঁর সাথে (কোনো উপাস্যকে) শরীক করে নি’।

হুযূর করীম (দ:) অন্যত্র এরশাদ ফরমান:

মধ্য-শা’বানের রাতে (শবে বরাতে) সপ্তম আসমানের দ্বারগুলো খুলে দেয়া হয়; আর প্রতিটি দ্বারে ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে মুসলমানদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন যতোক্ষণ না প্রত্যেক মুসলমানকে মাফ করা হয়; এর ব্যতিক্রম শুধু কবীরা গুনাহ সংঘটনকারীরা।

উম্মুল মো’মেনীন হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন:

রাসূলে পাক (দ:) এক রাতে আমার ঘরে ছিলেন; তিনি বিছানায় শুয়েছিলেন যতোক্ষণ না আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অতঃপর তিনি শয্যা ত্যাগ করেন এবং আমি (জেগে উঠে) তাঁকে (বিছানায়) পাই নি। তাঁকে দেখতে পেলাম নামাযে; সংক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে ও রুকু করে তিনি অত্যন্ত দীর্ঘ এক সেজদায় যান, যার ফলে অর্ধেক রাত তাতেই অতিবাহিত হয়। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় রাকআতে উঠে দাঁড়ান এবং আবারও রুকু করে দীর্ঘ সেজদায় সময় অতিবাহিত করেন, যার দরুন প্রায় ফজরের ওয়াক্ত উপস্থিত হয়। আমার এমন আশংকা হয় যে তিনি বুঝি বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলিত) হয়েছেন। তাই আমি তাঁর মোবারক কদমে হাত রাখি, আর তিনি নড়ে ওঠেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন। আমি তাঁকে বলতে শুনি, ‘এয়া আল্লাহ! আমি আপনাকে সেজদা করেছি (সারা) রাতের অন্ধকারে, আর (তাই) আমার অন্তর আপনার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। অতএব, মহাপাপ (কবীরা গুনাহ) ক্ষমা করে দিন, কেননা তা মহাপ্রভু ছাড়া কেউই মাফ করতে পারে না। আমি আপনার রুদ্ররোষ থেকে আপনারই রেযামন্দির (সন্তুষ্টির) মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি; আশ্রয় নিচ্ছি আপনার শাস্তি থেকে আপনারই ক্ষমার মাঝে; আর আপনার (রুদ্ররূপ) থেকে আপনারই মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আপনি যেভাবে আপনার প্রশংসা করেছেন, আমি তা পুরোপুরিভাবে করতে অক্ষম।’ অতঃপর নামাযশেষে তিনি আমায় বলেন, ‘ওহে আয়েশা! তুমি কি জানো এটি কোন্ রাত?’ আমি বল্লাম, ‘না।’ তিনি বল্লেন, ‘মধ্য-শা’বানের রাত (শবে বরাত)। এই রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের দিকে নজর করেন এবং যারা এতে ক্ষমাপ্রার্থী হয় তাদেরকে মাফ করেন; আর যারা তাঁর করুণা প্রার্থনা করে, তাদের প্রতি তিনি নিজ করুণা বর্ষণ করেন। কিন্তু যাদের অন্তরে বিদ্বেষ আছে, তাদেরকে তিনি আগের সে অবস্থাতেই রেখে দেন’।

হযরত আবূ নাসর (রা:) থেকে সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ’যম হযরত আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ:) তাঁর ‘গুনইয়াতুত্ তালেবীন’ পুস্তকে হযরত আয়েশা (রা:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন; তিনি বলেন:

মধ্য-শা’বানের রাতে একবার মহানবী (দ:) আমার একখানি বস্ত্র অপসারণ করেন। আল্লাহর কসম! আমার ওই বস্ত্র রেশমও ছিল না, মিহি রেশমও ছিল না; সেটি সুতোরও ছিল না, আবার সুতো ও তুলোর (মিশ্রণ)-ও ছিল না; (এমন কি) তুলোরও ছিল না।” বর্ণনাকারী (আবূ নাসর) বলেন, “আল্লাহরই প্রশংসা! তাহলে সেটি কিসের তৈরি ছিল?” হযরত আয়েশা (রা:) উত্তর দেন, “এর বনুন হয়েছিল চুল ও রেশমের সংমিশ্রণে। আমি ধারণা করেছিলাম যে তিনি হয়তো তাঁর অপর কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন; তাই আমি উঠে (অন্ধকার) কক্ষে তাঁর খোঁজ করি। আমার হাত তাঁর কদম মোবারক স্পর্শ করে। ওই সময় তিনি নামাযে সেজদারত ছিলেন। আমার মনে পড়ে, তিনি দোয়া করছিলেন এই বলে: ‘(এয়া আল্লাহ), আপনার সামনে সেজদারত আমার দেহ (মোবারক) ও রূহ (মোবারক), আর আমার অন্তর রয়েছে আপনারই হেফাযতে। আমি আপনার রহমত-বরকতের শোকর-গুজার করি এবং আপনার কাছেই আমার কৃতকর্ম স্বীকার করি। আমি এস্তেগফার করি; অতএব, আমায় মাফ করে দিন! আমি আপনার শাস্তি হতে আপনারই ক্ষমার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি; আপনার রুদ্ররোষ হতে আপনারই করুণার মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আপনার না-রাজি থেকে আপনারই রেযামন্দির মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আমি আপনার (রুদ্ররূপ) হতে আপনারই মাঝে আশ্রয় নিচ্ছি। আমি আপনার প্রশংসা করতে পারি না, কেননা আপনি তা-ই, যেভাবে আপনি আপনার নিজের প্রশংসা করেছেন’।

অতঃপর মা আয়েশা (রা:) আরও বলেন,

মহানবী (দ:) নামায পড়া ক্ষান্ত দেন নি, কখনো দাঁড়িয়ে, আবার কখনো বসে, যতোক্ষণ না ভোর হয়। অতঃপর তিনি তাঁর কদম মোবারক ওপরে তোলেন এবং আমি তা টিপে দেই। আমি তাঁকে বলি, আমার বাবা ও মা আপনার জন্যে কোরবান হোন। আল্লাহতা’লা কি নিশ্চয় আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কৃতকর্ম মাফ করে দেন নি? তিনি কি আপনার ব্যাপারে দয়াশীল হন নি? তা নয় কি? তা নয় কি? এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (দ:) উত্তর দেন, ‘ওহে আয়েশা! আমি কি তাহলে কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? তুমি কি জানো এই রাতে কী হয়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়ে থাকে? তিনি বল্লেন, ‘এ রাতে সকল (শিশুর) জন্মের (দিন-ক্ষণ) লিখে রাখা হয়; আর সকল মৃত্যুরও। এই সন্ধিক্ষণে মনুষ্যজাতির রিযক-ও বরাদ্দ করা হয়, আর তাদের কৃতকর্মের হিসেব নেয়া হয়।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর করুণা (রহমত) ছাড়া কি কেউই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন না? তিনি আমায় বল্লেন, ‘কেউই আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না।’ অামি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এমন কি আপনিও পারবেন না? বিশ্বনবী (দ:) উত্তর দিলেন, ‘না, এমন কি আমিও না, যতোক্ষণ না আল্লাহতা’লার রহমত আমাকে পরিবেষ্টন করছে।’ এরপর তিনি নিজ মস্তক ও চেহারা মোবারকে তাঁর হাত মোবারক বুলান।

[অনুবাদকের নোট: মহানবী (দ:)-এর উদ্ধৃত ‘কৃতকর্ম’ শব্দটি দ্বারা তিনি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে শিক্ষা দিয়েছেন। কেননা, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস হলো, আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ বে-গুনাহ। বিশ্বনবী (দ:)-এর ‘এস্তেগফার’ করার মানে উম্মতের জন্যে সুপারিশ ছাড়া কিছু নয় (সূরা নিসা, ৬৪)।]

হযরত আয়েশা (রা:) অন্যত্র বর্ণনা নবী করীম (দ:)-এর হাদীস, যিনি বলেন:

মধ্য-শা’বানের রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি নজর করেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদেরকে ক্ষমা করেন; আর যারা অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণ করে, তাদেরকে সেই অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।

— আত্ তাবারানী কৃত ‘কবীর’ পুস্তক

হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন যে বনূ কালব্ ওই সময় সবচেয়ে বড় গোত্র ছিল এবং এর সদস্যদের বড় বড় ভেড়ার পাল ছিল। অতএব, এই হাদীসে শেষ বাক্যটি ইশারা করে যে মহান আল্লাহ পাক ওই রাতে অসংখ্য মানুষকে মাফ করে থাকেন।

রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান,

মধ্য-শা’বানের রাতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের দিকে তাকান এবং এবাদত-বন্দেগীতে রত বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন; তবে দুই ধরনের লোককে তিনি ক্ষমা করেন না:

১/ অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারী এবং

২/ খুনী।

— ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীত ‘মুসনাদ’ ও আত্ তিরমিযী]

শবে বরাতে আল্লাহতা’লা তাঁর বান্দাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন ও মো’মেন তথা বিশ্বাসীদেরকে ক্ষমা করেন; আর অবিশ্বাসীদেরকে শাস্তি প্রদানে নিবৃত্তি দেন, এবং যারা বিদ্বেষভাব পোষণ করে তাদেরকে নিজ নিজ বিদ্বেষের আবর্তে ছেড়ে দেন, যতোক্ষণ না তারা তাঁর কাছে ক্ষমা চায়।

হযরত আবূ বকর (রা:) বর্ণনা করেন,

মধ্য-শা’বানের রাতে আল্লাহ পাক পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং প্রত্যেক মো’মেন (বিশ্বাসী) মুসলমানকে ক্ষমা করেন; এর ব্যতিক্রম শুধু পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান (আল-’আক্ক) ও যার অন্তরে বিদ্বেষভাব আছে।

— বায়হাকী তাঁর কৃত ‘শুআব’, ইবনে খুযায়মা (রা:) ও ইবনে হিব্বান (রা:)

আল-কাসিম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবি বকর সিদ্দিক (রহ:) তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর চাচা হতে বর্ণনা করেন যে তাঁর পিতামহ বলেন:

আল্লাহতা’লা মধ্য-শা’বানের রাতে তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন; ব্যতিক্রম শুধু যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে এবং যাদের অন্তরে বিদ্বেষভাব আছে।

— ইবনে যানজুউইয়ীয়্যা, আদ্ দারু কুতনী কৃত ’সুনান’, ইবনে আদী প্রণীত ‘কামিল’ এবং আল-বায়হাকী রচিত ‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে উদ্ধৃত

রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান,

শবে বরাতের রাতে আমাদের প্রভু খোদাতা’লা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং দুনিয়াবাসীকে মাফ করেন; ব্যতিক্রম কেবল মূর্তি পূজারী ব্যক্তিবর্গ ও অন্তরে বিদ্বেষভাব লালনকারী লোকেরা।

— ইবনে মূসা হতে ইবনে যানজুউইয়ীয়্যা বর্ণিত

হযরত মুয়ায (রা:) মহানবী (দ:)-এর কথা বর্ণনা করেন; তিনি বলেন:

আল্লাহ পাক শবে বরাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের নযর বিস্তৃত করেন এবং সবাইকে মাফ করেন; মাফ করেন না শুধু মুশরিক (মূর্তি পূজারী) ও অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তিবর্গকে।

নোটইবনে হিব্বান (১২:৪৮১ #৫৬৬৫), আল-আরনাওত এই এসনাদকে সহীহ বলেছেন;আত্ তাবারানী, আল-হায়তামী যার সনদকে সহীহ বলেছেন;আল-বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’ এবং ইবনে আসাকিরও এই হাদীস বর্ণনা করেন

রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ ফরমান:

নিশ্চয় আমাদের প্রভু শবে বরাতে উদিত হন এবং সৃষ্টিকুলকে ক্ষমা করেন; ব্যতিক্রম শুধু মূর্তি পূজারী ও অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তিবর্গ।

— ইবনে মাজাহ ও ইবনে মনসূর নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে

মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

মহান আল্লাহ পাক শবে বরাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি নজর করেন এবং সকল সৃষ্টিকে মাফ করেন; মাফ করেন না শুধু মূর্তি পূজারী ও অন্তরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তিদের।

— আল-বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’

শবে বরাতে আল্লাহতা’লা যমদূত আজরাঈলের কাছে ওই বছর যাদের জীবনাবসান চান, তাদের তালিকা প্রকাশ করেন।

— রশীদ ইবনে সা’আদ হতে আদ্ দায়নূরী নিজ ‘আল-মাজালিসা’ গ্রন্থে (মুরসালান)

হযরত উসমান ইবনে আবি আল-’আস হতে ইমাম বায়হাকী তাঁর ‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে শবে বরাতে আল্লাহ পাক ডেকে বলেন:

ক্ষমাপ্রার্থী কেউ আছ কি, যাকে আমি মাফ করতে পারি? আমার কাছে কোনো কিছূ প্রার্থী কেউ আছ কি, যাকে আমি তা মঞ্জুর করতে পারি?” ফলে যার যা প্রার্থনা, তা তিনি মঞ্জুর করেন; কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলো দুরাচারে লিপ্ত ব্যভিচারিনী এবং মূর্তি পূজারী।

হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর হাদীস; তিনি এরশাদ ফরমান:

মহান আল্লাহতা’লা মধ্য-শা’বানের রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হন এবং বনূ কালব্ গোত্রের মালিকানাধীন ভেড়ার পালের সমস্ত ভেড়ার লোমের চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করেন।

— সাঈদ ইবনে মনসূর প্রণীত ‘সুনান’ দ্রষ্টব্য

হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলে খোদা (দ:)-এর বাণী:

শবে বরাতে আল্লাহতা’লা বণূ কালব্ গোত্রের সমস্ত ভেড়ার লোমের সমপরিমাণ গুনাহ মাফ করেন।

— বায়হাকী কৃত ‘শুয়াবুল ঈমান’

হযরত আয়েশা হুযূর পূর নূর (দ:)-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন:

ওহে আয়েশা! তুমি কি ভেবেছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) তোমার প্রতি অন্যায্য আচরণ করবেন? বরঞ্চ জিবরীল আমীন আমার কাছে এসে বল্লেন, ‘এটি-ই মধ্য-শা’বানের রাত। আল্লাহতা’লা এ রাতে বনূ কালব্ গোত্রের সমস্ত ভেড়ার লোমের সমসংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি মাফ করেন না মূর্তি পূজারীদের কিংবা অন্যদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারীদের; অথবা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদেরও; অথবা পায়ের গোড়ালির নিচে বস্ত্র পরিধানকারীদেরও (যারা অর্থ-বিত্তের দম্ভের প্রতীকস্বরূপ তা পরে); কিংবা পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানদেরও; অথবা মদ্যপায়ীদেরও।

— বায়হাকী রচিত ‘শুয়াবুল ঈমান’

এ যাবত যতো হাদীস ও রওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে, সেগুলো একত্র করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে শবে বরাতের ফযীলত তথা ইহ ও পারলৌকিক উপকারিতার ভিত্তি সুদৃঢ়; আর এই পবিত্র রাত এবাদত-বন্দেগীতে কাটানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও বিদ্যমান। বস্তুতঃ এ সব হাদীদের কিছু কিছুকে বেশ কিছু হাদীসবিদ সহীহ (বিশুদ্ধ) হিসেবে বিবেচনা করেছেন, আর বাকিগুলোতে ছোটখাটো পরিভাষাগত ত্রুটি রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেছেন; এই পরিভাষাগত ত্রুটি হাদীসশাস্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন বর্ণনার সমন্বয়ে সারানো যায়। এ কারণেই এই উম্মাহ’র বুযূর্গানে দ্বীনবৃন্দ শবে বরাতকে রহমত-বরকতময় রজনী হিসেবে এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পালন করেছেন যুগে যুগে।



পবিত্র শবে বরাত এর প্রতিটি সময় অতি মূল্যবান



শবে বরাতের প্রতিটি ক্ষণ অতি মূল্যবান। এটি আপনার মালিকের পক্ষ থেকে আপনার জন্য বিশেষ দয়া ও রহমত। এ রাতের প্রতিটি মূহুর্ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি’র জন্য ব্যয় করা উচিত। নফল ইবাদত, নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, জিকির আসকার ইত্যাদির মাধ্যমে সারারাত অতিবাহিত করা উচিত। ফরজ নামাজগুলো অবশ্যই জামাতে পড়বেন। এ রাতে এমন কোন প্রোগ্রাম রাখবেন না যাতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। একাগ্রচিত্তে আল্লাহ ও রসূলের ( দঃ ) দিকে মনোনিবেশ করুন। দান খয়রাত করুন, চেষ্টা করুন অভাবী ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে ফিরিয়ে না দিতে। ভালখাবার তৈরি করুন । নিজেরা খান, অন্যকে খাওয়ান। আমাদের দেশে এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরির প্রচলন আছে তা করতে পারেন। কোন সমস্যা নাই। কিছু কিছু লোক আপনাকে হালুয়া রুটি তৈরি করত নিষেদ করবে। এরা এক ধরনের বেকুব বটে। খাবার দাবার হালাল হলেই সেটা করা যায়, খাওয়া যায় এতে কোন নিষেদ নাই। আমাদের দেশে আমরা ছোলামুড়ি দিয়া ইফতার করি, ঈদের দিন সেমাই পাকাই। এগুলো কোনটাই অবৈধ নয়। একইভাবে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খেলে অন্যকে খাওয়ালে ভাল’র চেয়ে মন্দ কিছু নাই। আল্লাহতো অন্যকে খাওয়ানো পছন্দ করেন। নিজে খাবেন, গরীব দুঃখী, আত্মীয় বন্ধুকে খাওয়াবেন। তবে এই খাওয়া দাওয়া যাতে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটায়।
 এ রাতে গোসল করাও পূণ্যময়। এ রাতে গোসলের প্রতি ফোটা পানির জন্য রয়েছে অতি উত্তমপ্রতিদান।কোনো বিষয়কে হারাম বলতে হলে নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক দলিল প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক;

🎒===ইসলামে কোন বিষয় কে হালাল হারাম করতে সুনিদিষ্ট দলিল দরাকার।
হযরত আবু দারদা (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলে খোদা (দ:) বলেন: ”আল্লাহতা’লা তাঁর কেতাবে (কুরআনে) যা কিছুর অনুমতি দিয়েছেন তা হালাল, যা কিছু নিষেধ করেছেন তা হারাম; আর যে ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছেন, তা ক্ষমাপ্রাপ্ত । অতএব, আল্লাহর ক্ষমা গ্রহণ করো, কেননা আল্লাহ বিস্মৃত হন না।” অতঃপর মহানবী (দ:) নিচের আয়াতে করীমা তেলাওয়াত করেন, ’আর আপনার প্রভু খোদাতা’লা কখনো বিস্মৃত হন না’ (সূরা মরিয়ম, ১৯:৬৪)। [ইমাম হায়তামী কৃত ’মজমাউয্ যাওয়াইদ’, ১:১৭১, হাদীস নং ৭৯৪]

ইমাম হায়তামী (রহ:) বলেন, এ হাদীসের বর্ণনাকারী হলেন আল-বাযযার এবং তাবারানী তাঁর ‘কবীর’ গ্রন্থে, ’যার নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের এসনাদ (সনদ) হাসান পর্যায়ভুক্ত।’
এই হাদীসকে সহীহ বলেছে নাসিরুদ্দীন আলবানীও, তার রচিত ‘সিলসিলাত আস্ সহীহাহ্ পুস্তকে (৫:৩২৫)

¤¤ ফরমানে মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): "যখন
মানুষ নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য সাওয়াবের নিয়্যতে ব্যয় করে তবে তা তার জন্য সদকাস্বরূপ ।"  (বুখারী, হাদীসঃ ৫৫)

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ এই হাদীস থেকে এটা জানা গেল যে, কোন মুবাহ (অথাত্-বৈধ) কাজও যদি ভাল নিয়্যতে করা হয়, তবে এটির জন্য সাওয়াব রয়েছে। ঘরের সদস্যদের লালন পালন মানুষ এমনিতেই করে থাকে কিন্তু যদি তাদের লালন পালন আল্লাহ তা'আলার সন্তষ্টির জন্য করা হয় তবে এটির ও সাওয়াব রয়েছে । সুবহানআল্লাহ ।
(নুযহাতুল ক্বারী, ১ম খন্ড, ৩৯৯ পৃষ্টা)

সুতরাং শব ই বরাত একটি বরকতময় রাত,এইরাত্রে যত ইবাদত করা যায় তত উত্তম,দান সদকা,ইত্যাদিও ইবাদতের অংশ।কেও যদি সওয়াবের নিয়তে নিজ পরিবার,প্রতিবেশী,আত্বীয় স্বজন কে সওয়াবের নিয়তে ভালো
খাবার খাওয়ানো হয় সেটিও সদকাসরুপ,আর সেটিওকে বেদাত বলার জন্য সুনিদিষ্ট দলিলের দরকার।

🎓===শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বা গোশত রুটি পাকানো
উল্লেখ্য, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোন বিশেষ খাবার তৈরী করা শরীয়তে নাজায়িয নয়। শবে  বরাত উপলক্ষে বিশেষ করে আমাদের  দেশ ও তার আশ-পাশের দেশসমূহে যে রুটি-হালুয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে তার পিছনে ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যামানায় যখন বর্তমানের মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-রেঁস্তরা ইত্যাদি সর্বত্র ছিলোনা তখন মানুষ সাধারণতঃ সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুসাফিরখানা ইত্যাদিতে ছফর অবস্থায় প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করতেন। অর্থাৎ মুসাফিরগণ তাদের সফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের ঘর-বাড়ি না পেলে সাধারণতঃ সরাইখানা, মুসাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করতেন। আর এ সমস্ত মুসাফিরখানা, লঙ্গরখানা ও সরাইখানার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকতেন তারাই মুসাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।

বিশেষ করে মুসাফিরগণ শবে বরাতে যখন উল্লিখিত স্থানসমূহে রাত্রি যাপন করতেন তখন তাদের মধ্যে অনেকেই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতেন ও দিনে রোযা রাখতেন। যার কারণে উল্লিখিত স্থানসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ খাবারের ব্যাবস্থা করতেন যাতে মুসাফিরদের রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করতে ও দিনে রোযা রাখতে অসুবিধা না হয়। আর যেহেতু হালুয়া-রুটি ও গোশ্ত-রুটি খাওয়া সুন্নত সেহেতু তারা হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটির ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও আরবীয় এলাকার লোকদের প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশ্ত। তারা ভাত, মাছ, ইত্যাদি খেতে অভ্যস্ত নয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, কোন আমলের ক্ষেত্রেই বদ রছম বা বদ প্রথার অনুসরণ করা জায়িয নেই।

এখন মাসয়ালা হচ্ছে- কেউ যদি শবে বরাত উপলক্ষে রছম-রেওয়াজ না করে বা নিজের ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে উক্ত হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করে তাহলে তা অবশ্যই জায়িয। শুধু জায়িয নয় বরং কেউ যদি তার নিজের ইবাদত-বন্দেগী ঠিক রেখে অন্যান্যদের জন্য যারা রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করবে ও দিনে রোযা রাখবে তাদের ইবাদত-বন্দেগী ও রোযা পালনের সুবিধার্থে হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটি অথবা আমাদের দেশে প্রচলিত খাদ্যসমূহের কোন প্রকারের খাদ্যের ব্যবস্থা করে তা অবশ্যই অশেষ ফযীলত ও নেকীর কারণ হবে।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت عبد الله بن سلام رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا ايها الناس افشوا السلام واطعموا الطعام وصلوا الارحام وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রচলন করো, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সর্ম্পক রক্ষা করো এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়ো তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারিমী

বুধবার, ৪ মে, ২০১৬

মাহে রজব মাস এর ফজিলত ও বরকত

মাহে রজব এর ফজিলত ও বরকত

Ya Nabi
মাহে রজব হিজরী বর্ষের ৭ম মাস। পবিত্র হাদীস শরীফে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ মাসের বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
নামকরণ ঃ
‘কামূস’ নামক প্রসিদ্ধ অভিধানে রাজাবা’র অর্থ লিখেছেন- ‘ভীতিপ্রদর্শন করেছে’, ‘সম্মান করেছে’। এ থেকে ‘রজব শব্দের উৎপত্তি। রজব মাসে ক্বোরবানী করাকে আরবীতে ‘তারজীব’ বলা হয়। আরববাসীগণ এ মাসের প্রতি সম্মান করে আসতো। আল্লামা জাযারী তাঁর ‘নিহায়াহ’য় লিখেছেন- ‘তারজীব’ মানে ‘তা’যীম করা’। এ কারণে আরববাসীগণ রজব মাসকে সম্মান করতো। মাহে জুমাদাল উখরা ও মাহে শা’বানের মধ্যবর্তী মাস হচ্ছে ‘রজব’। এ মাসকে ‘রজব-ই মুদ্বার (মুদ্বার গোত্রের রজব মাস) ও বলা হতো। হাদীস শরীফে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ মাসের অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েছেন ‘রজব’ হ্েচ্ছ জুমাদাল উখরাহ ও মাহে শা’বানের মধ্যবর্তী মাস। এর কারণও এ যে, জাহেলী যুগের লোকেরা এ মাসকে মনগড়াভাবে সরিয়ে দিয়ে অন্য মাসকে তদস্থলে সাব্যস্থ করতো। তারা ওই যুগে দিন এবং মাসেও কম বেশী করে ফেলতো। তাদের এসব খেয়াল ও কাজকে বাতিল ঘোষণা
করে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকিদ সহকারে ওই মাসের অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েছেন ।
উল্লেখ্য, জাহেলী যুগের লোকেরা রজব মাসে যে ক্বোরবানীর নামে পশু যবেহ করতো সেটাকে ‘আতীরাহ-ই রজবিয়া বলা হতো। ‘রজবকে ‘আসাম্মা’ বা বধিরও বলা হতো। কারণ ‘ক্বামূস’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘রজব বধির’ অর্থাৎ এ মাসে কোন বিশেষ শব্দ আসতো না। আর কোন আহবানকারী ‘ওহে অমুক, ওহে বন্ধু’ ইত্যাদি বলেও আহবান করতো না।
‘নিহায়াহ’য় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘আল্লাহর মাস রজব’ প্রকৃত পক্ষে বধির। কেননা, এ মাসে হাতিয়ারের ঝনঝনানির শব্দ আসতো না । আর যেহেতু এটা সম্মানিত মাস, সেহেতু মানুষের গুণকে সামনে রেখে এ মাসও ‘বধির’ বলে আখ্যায়িত হতে থাকে। [মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ ফী আইয়্যামিস সানাহ]
ভূল ধারণার অপনোদন ঃ
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি তাঁর ‘মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ’য় আরো লিখেছেন যে, এ মাসকে ‘বধির’ বলে আখ্যায়িত করার পেছনে কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তাও মুসলিম সমাজে বিরাজ করেছে যেমনঃ_
এক ঃ হাশরের দিনে এ মাস নিজে বধির হয়ে যাবে। মানুষের অপরাধগুলো ও দোষ-ত্রটির সাক্ষ্য দেবে না। আর বলবে, “আমি তো বধির। আমি কোন কিছু শুনতে পাচ্ছি না।”
দুই ঃ এ মাসকে আল্লাহর মাস এজন্য বলা হয় যে, এ মাস বান্দাদের দোষ-ত্রুটি গোপনকারী, যা আল্লাহ পাকের সুন্নাত। কারণ তাঁর একটি গুণবাচক নাম হচ্ছে ‘সাত্তার’ অর্থাৎ বান্দাদের দোষ-ত্রুটি গোপনকারী।
বস্তুত এ দু’টি যুক্তিই ভিত্তিহীন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা ‘সাত্তার’ (দোষ গোপনকারী) হওয়ার অর্থ এ যে, না’উযুবিল্লাহি মিন যালিকা, বধিরতার বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে। আর এ কথা একেবারে স্পষ্ট যে, বধির ব্যক্তি তার বধিরতার কারণে শুধু কারো কথা ও কথোপকথন শুনতে অক্ষম হয় এবং বধিরতার ওযর পেশ করে মানুষের কথাবার্তা গোপন করতে পারে মাত্র। (সঠিক বিষয় তো আল্লাহর জানা আছে)।
মাহে রজবের ফযীলত ঃ
জামে’উল কবীর’- এ মাহে রজবের বহু ফযিলত ও রজব মাসের আমল সমূহের ফযিলত উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
এক. আবুল ফাতহ ইবনে ফাওয়ারিস তাঁর ‘আমলী’ নামক কিতাবে হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে ‘মুরসাল’ সূত্রে লিখেছেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- রজব আল্লাহর মাস। শা’বান আমার মাস। আর রমযান হচ্ছে আমার উম্মতের মাস। রজব ওই মহান মাস, যাতে নেক কাজগুলোর সাওয়াব বহুগুণ বেশি দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে একদিন রোযা রাখবে, তাকে গোটা বছরের রোযার মতো সাওয়াব দেওয়া হবে।
দুই. ইমাম রাফে’ঈ সা’ঈদের মৌখিক বর্ণনা লিখেছেন- রজব নিঃসন্দেহে আল্লাহর মাস। সেটাকে বধির (আসাম্ম) এজন্য বলা হয় যে,
জাহেলী যুগেও লোকেরা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতো এবং নিজেদের হাতিয়ার তুলে রাখতো। লোকেরা এ মাসে নিরাপদে শান্তিতে থাকতো। সমস্ত রাস্তা নিরাপদ হতো। কেউ কারো ভয়ে ভীত থাকতো না । এ গোটা মাসেই নিরাপত্তা ও শান্তি পরিলক্ষিত হতো।
তিন. ইমাম বায়হাক্বী তার ‘শু’আবুল ঈমান’- এ হযরত আয়েশা সিদ্দিক্বার মৌখিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন- রজব ওই মহান মাস; যাতে আল্লাহ তায়ালা নেক কাজগুলোর সাওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করে দান করেন।
যে ব্যক্তি এ মাসে একদিন রোযা রেখেছে, সে যেনো গোটা বছর রোযা রেখেছে। যে ব্যক্তি এ মাসে সাতদিন রোযা রাখে, তার জন্য দোযখের সাতটি দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি এ মাসে আটদিন রোযা রাখে, তার জন্য বেহেশতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ মাসে দশদিন রোযা পালনকারী আল্লাহর দরবারে যা চাইবে, তাকে আল্লাহ তায়ালা তা দান করবেন। আর যে ব্যক্তি এ মাসে পনেরটি রোযা পালন করবে, আসমান থেকে এক আহবানকারী আহবান করে- ‘হে রোযাদার! তোমার বিগত সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওযা হয়েছে। এখন থেকে নেক আমল আরম্ভ করে দাও! যে ব্যক্তি বেশি পরিমাণে ভাল কাজ করবে, তাকে সাওয়াবও অধিক দেওয়া হবে।
চার. ইমাম বায়হাক্বী তার ‘শু’আবুল ঈমান’- এ লিখেছেন, রজব মাসে একদিন ও একরাত অতিমাত্রায় মহান ও ফযিলত মন্ডিত। যে ব্যক্তি ওইদিন রোযা রাখে এবং ওই রাতে ইবাদত করে, সে যেনো একশ বছর রোযা রাখলো এবং একশ বছর ইবাদত করেছে। আর ওই তারিখ হচ্ছে ২৭ রজব। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর শির মোবারকে ‘নুবূয়তের তাজ’ পরিয়েছেন।
শবে রাগাইব ও এর নামায ঃ
মাহে রজবের প্রথম বৃহস্পিতিবার দিবাগত রাতকে লোকেরা ‘লায়লাতুর রাগাইব’ বলে। মাশাইখে কেরামের মতে, এ রাতে বিশেষ নিয়মে এক নামায পড়া হয়; (যদিও মুহাদ্দিসগণ [[মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ]
এ মাসের আমল সমূহ ঃ
ঙ্ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন যখন রজব মাস দেখবে প্রথমে একবার নিম্নলিখিত দোয়া পড়বে-
আল্লাহুম্মা বা-রিক লানা- ফী রাজাবা ও শা’বা-না ওয়া বালি্লগনা ইলা শাহরে রামাদ্বা-না।
অর্থঃ- হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শা’বানে বরকত নাযিল করো এবং আমাদেরকে রমযান মাস পর্যন্ত পেঁৗছিয়ে দাও।
ঙ্ মাহে রজবের রাতে এশার নামাযের পূর্বে বিশ রাক’আত নামায দশ সালামে পড়বেন। প্রতি রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা কাফিরূন’ তিনবার করে এবং ‘সূরা ইখলাস’ তিনবার করে পড়বেন। ইনশাল্লাহু তায়ালা এ নামায সম্পন্নকারীকে আল্লাহ পাক কি্বয়ামত দিবসে শহীদদের অন্তর্ভূক্ত করবেন এবং তার হাজার মর্যাদা বুলন্দ করবেন।
ঙ্ প্রথম রাতে এশার নামাযের পর চার রাক’আত নামায দু’সালামে পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আত সূরা ফাতিহার পর সূরা ‘আলাম নাশরাহ’ একবার, সূরা-ই ইখলাস’ একবার, ‘সূরা ফালাক্ব’ একবার ও ‘সূরা নাস’ একবার পড়বেন। যখন দু’রাক’আত পড়ে সালাম ফেরাবেন, তখন কলেমা-ই তাওহীদ ৩৩ বার ও দুরূদ শরীফ ৩৩ বার পড়ে যে কোন প্রয়োজন হয় আল্লাহ পাকের নিকট চাইবেন। ইনশাল্লাহু তায়ালা প্রতিটি প্রয়োজন পূরণ হবে।
ঙ্ রজবের প্রথম রাতে এশার নামাযের পর আরো দু’রাক’আত নামায এভাবে পড়া যায়ঃ সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস একবার পড়বেন। ইনশাল্লাহু তায়ালা এ নামাযের বরকতে আল্লাহ পাক তাকে সুস্থতা দান
করবেন। রোগীর আরোগ্য লাভের জন্য এ নামায অতীব ফযিলতমন্ডিত ও উপকারী।
ঙ্ প্রথম রাতে তাহাজ্জুুদের নামাযের সময় দশ রাক’আত নামায দু’রাক’আত করে পাঁচ সালামে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর দু’হাত তুলে একবার কলেমা-ই তাওহীদ পড়বেন। অতঃপর একবার নিম্নলিখিত দো’য়া পড়বেন-
উচ্চারণ ঃ আল্লাহুম্মা লা-মা-নি’আ লিমা-আ’ত্বোয়াতা, ওয়াইলা মু’তি্বয়া লিমা-মানা’তা, ওয়ালা ইনফা’উ যাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দু।
এ দো’আ পাঠ করে আল্লাহ পাকের দরবারে যে কোন জিনিসের জন্য দো’আ করবেন, ইনশাল্লাহ কবুল হবে।
ঙ্ মাহে রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে লাইলাতুর রাগা-ইব এশার নামাযের পর দু’রাক’আত নফল নামায পড়বেন- প্রথম রাক’আত সূরা ফাতিহার পর সূরা বাক্বারার শেষ রূকু’ (আমানার রাসূল থেকে কাফিরুন) পর্যন্ত সাতবার পড়বেন। তারপর ২য় রাক’আত নফল নামায পড়বেন- প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা হাশর’ এর শেষ তিন আয়াত (হুয়াল্লাহুল্লাযি থেকে হাকিম) পর্যন্ত সাত বার পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর আল্লাহ পাকের দরবারে যে কোন দো’আই করবেন, ইনশাল্লাহ পূরণ হবে। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এ নামায অতি উত্তম তথা উপকারী।
ঙ্ মাহে রজবের ‘প্রথম জুমু’আ’র দিন যোহর ও আসরের মধ্যবতর্ী সময়ে চার রাক’আত নামায এক সালামে পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘আয়াতুল কুরসী’ সাতবার ও ‘সূরা-ই ইখলাস’ পাঁচবার পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর পঁচিশ বার পড়বেন-
উচ্চারণঃ লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা-বিল্লা-হিল করীবিল মুতা’আল। অতঃপর ১০০ বার নিম্নলিখিত ইসতিগফার পড়বেন-
উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা-ইল্লা-হুয়াল হাইয়ু্যল ক্বাইয়ূ্যমু গাফ্ফারুয্যুনু-
বি ওয়া সাত্তা-রুল উয়ূ-বি ওয়া আতু-বু ইলাইহি।
অতঃপর ১০০ বার দুরূদ শরীফ পড়ে যে কোন দো’আই করবেন- চাই পার্থিব বিষয়ে হোক, চাই দ্বীনি বিষয়ে হোক। ইনশাল্লাহু তায়ালা আল্লাহর দরবারে অবশ্যই কবূল হবে।
ঙ্ মাহে রজবের ৭ম, ১৫তম ও ২৭তম রাতগুলোর মধ্যে যে কোন রাতে এশার নামাযের পর বিশ রাক’আত নামায দশ সালামে পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা-ই ফাতিহার পর সূরা ইখলাস একবার করে পড়বেন। আল্লাহ তায়ালা এ নামায সম্পন্নকারীকে দুনিয়াবী ও দ্বীনি সমস্ত আপদ থেকে নিরাপদে রাখবেন এবং পূল সেরাতের রাস্তা পাড়ি দেওয়া তার জন্য সহজ হবে।
ঙ্ পঞ্চদশ রাতে এশার নামাযের পর বিশ রাক’আত নফল নামায দশ সালামে পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস একবার করে পড়বেন। ইনশাল্লাহ্ তায়ালা আল্লাহ পাক ওই নামাযের অসংখ্য সাওয়াব দান করবেন। আর এ নামায সম্পন্নকারীর গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়বে, যেমন গাছের শুষ্ক পাতা ঝরে পড়ে।
ঙ্ মাহে রজবের যে কোন জুমু’আর রাতে এশার নামাযের পর দু’রাক’আত নামায পড়বেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসী এগার বার, সূরা যিলযাল এগার বার, সূরা তাকাসূর এগারবার পড়বেন। সালাম ফিরানোর পর আল্লাহ পাকের দরবারে আপন গুনাহ সমূহের মাগফিরাত প্রার্থনা করবেন। ইনশাল্লাহ এ নামায সম্পন্নকারীর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে আল্লাহ তাকে দয়া করবেন।
বৎসরের চৌদ্দ রাত্রিঃ
হযরত গাউসূল আযম আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু “গুনিয়াতুত ত্বালেবীন” গ্রন্থে বৎসরের চৌদ্দটি রাত্রির কথা উল্লেখ করে ঐ
রাত্রসমূহে ইবাদত করা মোস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন_
শরীয়তের কতেক বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম রাহিমাহুমূল্লাহ এমন কতগুলো রাত্র গণনা করে উল্লেখ করেছেন, যে রাত্রগুলোতে ইবাদত করা মোস্তাহাব। বৎসরের ঐ রাত্রগুলোর সংখ্যা হলো ১৪টি। যথা-
১। মুহাররম মাসের প্রথম রাত্র।
২। মুহাররম মাসের ১০ম রাত্র। (আশুরার রাত্র)
৩। রজব মাসের প্রথম রাত্র।
৪। রজব মাসের ১৫ই রাত্র।
৫। রজব ২৭ শে রাত্র। (শবে মি’রাজ)
৬। শা’বান মাসের ১৫ই রাত্র। (শবে বরাত)
৭। রোযার ঈদের রাত্র (শাওয়াল মাসের ১লা রাত্র)
৮। আরাফাতের রাত্র (৯ই যিলহজ্ব রাত্র)
৯। কোরবানীর ঈদের রাত্র (১০ই যিলহজ্ব রাত্র)
১০-১৪। রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় ৫ রাত্র (২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রাত্র)। (গুনিয়াতুত ত্বালেবীন পৃষ্ঠা- ২৩৬)
ঐ ১৪ রাত্র সমূহে নামায পড়ার নিয়ম ঃ
হযরত গাউসুল আযম আবদুল কাদির জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শবে বরাত সহ বৎসরের ঐ ১৪ রাত্রে নফল নামায পড়ার তরতীব ও নিয়ম এভাবে বর্ণনা করেছেন_
“শাবান মাসের ১৫ই রাত্রে যে নিয়মে নফল নামায পড়ার বিষয়ে রেওয়ায়াত এসেছে- তা হচ্ছে এক হাজার বার কুল হুয়াল্লাহু সূরা দ্বারা একশত রাকআত নফল নামায আদায় করা- প্রতি রাক’আতে দশবার করে কুলহুয়াল্লাহু সূরা পড়তে হবে। এ নামাযের নাম হচ্ছে “সালাতুল খাইর”। এই নামাযের বিভিন্ন বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বকার সলফে সালেহীন ও বুযুর্গানে দ্বীন একত্রিত হয়ে জামাআতের সাথে এই নামায আদায় করতেন। এই নামাযে অনেক ফযিলত ও অনেক সাওয়াব রয়েছে। হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে- তিনি
বলেন, “আমাকে নবীজীর ত্রিশজন সাহাবী বলেছেন যে, যে ব্যক্তি শবে বরাতে উক্ত নামায পড়বে, আল্লাহ তার ৭০টি হাজত বা মকসুদ পূরণ করবেন। ঐ ৭০টি মকসুদের মধ্যে নিম্নতম হলো- গুনাহ ক্ষমা।” (হযরত গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শবে বরাতের নামাযের নিয়ম ও ফযিলত বর্ণনা করার পর বলেন) “আমি রজব মাসের ফযিলতের অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে যে ১৪টি রাত্রির উল্লেখ করেছি_ সবগুলোতেই এই “সালাতুল খাইর” পড়া মোস্তাহাব।
শবে মি’রাজের নফল নামায ঃ
রজবের ২৭তম রাতে বার রাক’আত নামায তিন সালামে পড়বেন। প্রথম চার রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা ক্বদর’ তিনবার করে প্রত্যেক রাক’আতে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর বসে ৭০ বার পড়বেন-
উচ্চারণ ঃ লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহুল মালিকুল হক্বক্কুল মুবীন।
দ্বিতীয় চার রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা নাসর’ তিনবার করে প্রত্যেক রাক’আতে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর বসে ৭০ বার পড়বেন_
লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহুল মালিকুল হক্বক্কুল মুবীন।
তৃতীয় চার রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা ইখলাস’ তিনবার করে প্রত্যেক রাক’আতে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর বসে সত্তরবার ‘সূরা আলাম নাশরাহ’ পড়বেন। তারপর আল্লাহ রাব্বুল ইয্যাতের মহান দরবারে দো’আ প্রার্থনা করবেন। ইনশাল্লাহু তায়ালা যে প্রয়োজনই থাকুক না কেন, তা আল্লাহ পাক পূরণ করবেন।
ঙ্ মাহে রজবের ২৭ তারিখ রাতে আরো চার রাক’আত নামায দু’সালামে পড়তে পারেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা ইখলাস এক বার করে পড়বেন। ইনশাল্লাহ তা’য়ালা যে কেউ এ নামায সম্পন্ন করবে
আল্লাহ তায়ালা তার জান ও মালকে হিফাযত করবেন।
ঙ্ মাহে রজবের ২৭ তারিখ রাতে আরো চার রাক’আত নামায দু’সালামে পড়তে পারেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর ‘সূরা ইখলাস ২৭ বার করে পড়বেন। সালাম ফেরানোর পর সত্তর বার দুরূদ শরীফ পড়বেন এবং আপন গুনাহগুলোর মাগফিরাত কামনা করবেন। ইনশাল্লাহহু তায়ালা পরওয়ারদিগারে আলম আপন পূর্ণাঙ্গ রহমত দ্বারা গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
ঙ্ মাহে রজবের ২৭ তারিখ যোহরের নামাযের পর চার রাক’আত নামায এক সালামে পড়বেন। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ক্বদর তিনবার, দ্বিতীয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস তিনবার, তৃতীয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস তিনবার এবং চতুর্থ রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা নাস তিনবার পড়বেন। সালাম ফিরানোর পর দুরূদ শরীফ ১০০ বার ও ইস্তিগফার ১০০ বার পাঠ করবেন। এ নামায প্রত্যেক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইনশাল্লাহ অতি মাত্রায় উত্তম ও ফলপ্রসূ।
ওযীফাঃ
মাহে রজবের ১ম তারিখ থেকে প্রত্যেক নামাযের পর তিনবার করে নিম্বলিখিত দো’য়া পাঠ করার বহু ফযিলত রয়েছে-
উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল আযী-মাল্লাযী লা-ইলাহা ইল্লা-হুয়াল হাইয়ূ্যল ক্বাইয়ূম। ইলাইহি তাওবাতু আবদিন যা-লিমিন লা-ইয়ামলিকু নাফসাহু দ্বাররাওঁ ওয়ালা নাফ’আন ওয়ালা মাওতান ওয়ালা হায়া-তান ওয়ালা নুশূ-রা।
ঙ্ রজব মাসের ১৫ তারিখে কোন নামাযের পর একশ’ বার এ ইসতিগফার পড়লে বহু ফযীলত পাওয়া যায়। এ দো’আ পাঠকের সমস্ত পাপ মুছে আল্লাহ পাক সেগুলো নেকীতে পরিবর্তিত করে দেবেন।
ইস্তিগফারটি নিম্নরূপ-
উচ্চারণ ঃ আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা-ইলাহা ইল্লা-হুয়াল হাইয়ূ্যল ক্বাইয়ূ্যম, গাফ্ফারুয যুনূবি ওয়া সাত্তারুল উয়ূবি ওয়া আতূ-বু ইলাইহি।
ঙ্ মাহে রজবের যে কোন তারিখে যোহর, মাগরিব ও এশার নামাযের পর সূরা কাহফ একবার, সূরা ইয়াসীন একবার, সূরা হা-মীম একবার, সূরা দুখান একবার, সূরা মা’আরিজ একবার পড়বেন। তারপর ১০০০ বার সূরা ইখলাস পড়বেন। আল্লাহ তায়ালা এ সূরাগুলো তিলাওয়াতকারীর উপর রহমত বর্ষণ করবেন ও বরকত (কল্যাণ) দান করবেন।
নফল রোযা ঃ
হুযুর-ই আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, রজব মাসের রোযার বহু বড় ফযিলত রয়েছে। আর ২৭ তারিখের রোযার সাওয়াব খুব বেশী। এ রোযার ফলে কবরের আযাব ও দোযখের আগুন থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।
রজব মাসের বিশেষ ঘটনাবলী ঃ
ঙ্ বর্ণিত আছে যে, এ বরকতময় মাসের প্রথম তারিখে সাইয়্যেদুনা নূহ আলাইহিস সালাম ‘কিস্তি’র উপর আরোহণ করেছিলেন। সেদিন তিনি নিজেও রোযা রেখেছেন, আপন সাথীদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর বরকতেও আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তূফান ও জলোচ্ছ্বাস থেকে নাজাত দিয়েছেন, শত্রুদের ধ্বংস করেছেন এবং ভূ-পৃষ্ঠ কুফর ও শির্ক থেকে মুক্ত হয়েছিল।
ঙ্ মাহে রজবের ১২ তারিখে হযরত জাফর সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বরকতময় জন্ম হয়েছিলো। এ মাসের ২২ তারিখে তাঁর খতম শরীফের আয়োজন করা হয়।
ঙ্ ১৫ তারিখে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার সাথে কথোপকথন করেন। আর হযরত সাইয়্যেদুনা ইদ্রীস
আলাইহিস সালামকে আসমানের উপর উঠানো হয়েছিলো।
ঙ্ ২৭ রজব হুযুর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজের দুলহা হয়েছিলেন। আর আল্লাহর দীদার ও অন্যান্য বহু পুরস্কার ও বুযুর্গী দ্বারা ধন্য হয়েছেন।
ঙ্ এ মাসের ২৮ তারিখে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নবূয়তের ঘোষণা ও তাঁর ওহী আসার সূচনা হয়েছে।
এ মাসে যেসব বুযুর্গের ওফাত শরীফ হয়েছিলো তাঁদের কয়েকজন ঃ
ঙ্ হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৭ রজব, ৩৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত আমীর মু’আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ২২ রজব, ৬০ হিজরী।
ঙ্ হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ১০ রজব, ৩৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত ইমাম-ই আযম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৪ রজব, ১৫০ হিজরী।
ঙ্ হযরত ইমাম শাফে’ঈ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ১লা রজব, ২০৪ হিজরী।
ঙ্ হযরত ইমাম আবূ ইউসূফ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৭ রজব, ১৮৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত ইমাম মূসা কাযিম রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৫ রজব, ১৮৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত ইমাম তিরমিযী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ১৩ রজব, ২৬৯ হিজরী।
ঙ্ হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৭ রজব, ২৯৮ হিজরী।
ঙ্ হযরত খাজা মুঈন উদ্দীন আজমিরী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ৬ রজব, ৬৩৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত খাজা হুসামুদ্দীন খালাফে খাজা আজমিরী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ৬ রজব, ৬৩৩ হিজরী।
ঙ্ হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন মাওদূদ চিশতী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ১লা রজব।
ঙ্ হযরত শামসূদ্দীন তাবরীযী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ৯ রজব, ৯৪৪ হিজরী।
ঙ্ হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপথি রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৫ রজব, ১৩০২ হিজরী।
ঙ্ হযরত শাহ নি’মাতুল্লাহ ওয়ালী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৫ রজব ।
ঙ্ বাদশাহ শাহ্জাহান রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২৬ রজব, ১০৭৬ হিজরী।
ঙ্ আল্লামা গাজী শেরে বাংলা আযীযুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ১২রজব, ১৩৮৯ হিজরী।
ঙ্ শাহ আবুল হোসাঈন নূরী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ১১ রজব, ১৩২৪ হিজরী ।
ঙ্ মাওলানা সাইয়্যেদ দীদার আলী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ২১ রজব, ১৩৫ হিজরী।
[সূত্র ঃ মাসিক রেযা-ই মোস্তফা, গুজরানওয়ালা মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ, বারাহ মাহ কী নফল নামায]
রজব মাসের ফজিলত
নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার নিকট গণনার মাস ১২টি। এতে কম-বেশি করার ক্ষমতা কারো নেই। এই মাসগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারিত করা হয়েছে আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করার পর। (আল কুরআন : সুরা তওবা)।
মাহে রজব আরবী বর্ষের ৭ম মাস। বায়হাকী শরীফে আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মাহে রজবের নব চন্দ্র দেখতেন, তখন তিনি বলতেন-আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজাবা ওয়াশাবানা ওয়া বাললিগনা শাহরি রামাজান।’ অর্থ হচ্ছে, হে আল্লাহ আমাদের প্রতি রজব ও শাবান মাসকে বরকতস্বরূপ দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। হাদীসে পাকে মাহে রজবের বহু ফজিলত ও আমলের কথা বর্ণিত আছে। তার মধ্যে এখানে কিছু বাণী তুলে ধরা হল। 
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মাহে রজব আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মাস। যে ব্যক্তি মাহে রজবকে সম্মান প্রদর্শন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করবেন।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে আমার সাথীগণ! জিব্রাইল আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে মাহে রজবের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে বলেছেন, রজবের ইবাদত মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত কোন মুশরিকের ভাগ্যে হয় না।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মাহে রজব আল্লাহর মাস। মাহে শাবান আমার মাস। আর মাহে রমজান আমার ও আমার উম্মতের মাস। একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মনে করলেন কবরবাসীকে আযাব দেয়া হচ্ছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে যদি রজব মাসে একটি রোযাও রাখতো, তাহলে তাকে এত কষ্ট দেয়া হতো না।
মাহে রজবের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত একটি অধিক পুণ্যময় রাত। এই রাতটিকে আরবীতে লাইলাতুল মেরাজ বলা হয়। এ রাতের গুরুত্ব, তাত্পর্য, ফজিলত ও বরকত অনেক বেশি।
আল কোরআনের ১৫ পারা সুরা বনী ইসরাঈলে এ রাতের যে ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে তা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মেরাজ নামে বিশ্ব ইতিহাসে সুপরিচিত। এই রাতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার আদেশক্রমে মক্কা শরীফ থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস-ঊর্ধ্বাকাশে, আরোহণ করে আল্লাহ তায়ালার অধ্যাদেশ প্রাপ্ত হন।
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মেরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মহানেয়ামত দান করেন। ১। উম্মতের জন্য মেরাজস্বরূপ ৫ ওয়াক্ত নামাজ।
আর সুরা বণী ইসরাইলে ১৪টি অধ্যাদেশাবলী। মূলত রজব মাস হলো রমজানের প্রস্তুতির মাস। এই মাস হতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। যার ফলে ইবাদত ও বন্দেগীও বেশি করতেন। সেজন্য তাঁর উম্মত হিসেবে আমাদেরও উচিত এখন থেকে হূদয় কন্দরে পবিত্র রমজানুল মোবারকের একটি আবহ তৈরি করা এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য ইবাদত বন্দেগীও বেশি বেশি করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন, আমীন।